‘স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ’কে আপ্তবাক্য হিসেবে গ্রহণকারী দেশ ফ্রান্সে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফার ভোটে কট্টর ডানপন্থীরা আশাতীত সাফল্য লাভ করেছে। এটা দীর্ঘদিনের ব্যবধানে একজন সমাজতন্ত্রীর ক্ষমতায় আসীন হওয়ার সম্ভাবনাবিষয়ক আলাপ-আলোচনাকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। প্রথম দফার ভোটে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও রক্ষণশীল ইউএমপির প্রার্থী নিকোলা সারকোজির তুলনায় এগিয়ে থেকেছেন পার্টি সোশ্যালিয়েস্তার ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ। প্রথমজন প্রদত্ত ভোটের ২৭ ভাগের সামান্য বেশি এবং দ্বিতীয় জন ২৮ ভাগের কিছু বেশি ভোট পেয়েছেন। ১৯৫৮ সালে ফিফথ রিপাবলিকের সূচনার পর থেকে প্রথম দফার ভোটে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের হেরে যাওয়া এই প্রথম কিন্তু এসব এখন দ্বিতীয় আলোচ্য। ১৮ ভাগের বেশি ভোট পেয়ে ফ্রন্ট ন্যাশনাল দলের মারি লে পেনের তৃতীয় স্থান লাভ করাটাই হচ্ছে এ মুহূর্তে ফ্রান্সসহ গোটা ইউরোপের প্রধান আলোচনা। ইউরোপের দেশে দেশে উদারনীতিকদের মধ্যে পেনের উত্থানকে বড় এক আশঙ্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এমনকি, সারকোজির সমর্থক জার্মানির রক্ষণশীল চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল পর্যন্ত পেনের উত্থানকে ‘ত্রাসজনক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এটা এখন স্পষ্ট যে ন্যাশনাল সমর্থকদের মতিগতির ওপরই আগামী ৬ মে অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় দফার ভোটের ফলাফল অনেকাংশে নির্ভর করবে। সাদা চোখে মনে হতে পারে, একটা দল প্রথম দফার ভোটে তৃতীয় হয়েছে এবং দ্বিতীয় দফার ওপরে তাদের সমর্থনের প্রভাব থাকছে, তাতে কী হয়েছে? আসলে অনেক কিছুই হয়ে গেছে। বলতে কি ‘একটা ভূত’ এখন ইউরোপের উদারনীতিকদের তাড়া করছে, উগ্র ডানপন্থার ভূত। এই ভূত ভিন্ন জাতি, ভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষ, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন সংস্কৃতিবিদ্বেষী এবং এই ভূতের সমর্থন বাড়ছে শ্রমজীবী শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে। ফ্রন্ট ন্যাশনালে এই ভূতের ফরাসি সংস্করণ বলা চলে। পেনের দল অভিবাসন ও অভিবাসীদের চরম বিরোধী, অভিবাসন ঠেকানোর জন্য সীমান্তে কঠোরতম নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার দাবিদার। ফরাসিদের জীবনমান নেমে যাওয়ার পেছনে অভিবাসীদেরই এরা দায়ী করতে চায়; আর মনে করে যে সারকোজি নিজে একজন রক্ষণশীল হয়েও সাবেক উপনিবেশসহ গরিব দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসনের স্রোত ঠেকানো তো দূরের কথা, যারা ঢুকে পড়ার পরে ধরা পড়েছে, তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছেন। ফ্রন্ট ন্যাশনালের বক্তব্য হচ্ছে, অভিবাসীদের হাত থেকে বাঁচার প্রয়োজনে ফ্রান্সকে ২২টি ইউরোপীয় ও তিনটি অ-ইউরোপীয় দেশের সমন্বয়ে গঠিত শেনজেন এলাকা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। উল্লেখ্য, শেনজেনভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণের জন্য যেসব দেশের নাগরিকদের ভিসা প্রয়োজন হয়, তারা যেকোনো একটি দেশের ভিসা সংগ্রহ করলেই চলে। ফ্রন্ট ন্যাশনালে ‘দ্বৈত নাগরিকত্ব’ ব্যবস্থারও বিরোধী। তাদের কথা হচ্ছে, যে লোকগুলো ফ্রান্সের নাগরিকত্ব পাওয়ার পরও ছেড়ে আসা দেশের নাগরিকত্ব রেখে দেয় তারা আসলে ফ্রান্সের প্রতি কখনোই প্রকৃত অর্থে নিবেদিতপ্রাণ হয় না। এদের কথা হচ্ছে ‘ন্যাশনালিটি’ জন্মগত বিষয়, অতএব ‘ন্যাচারালাইজেশন’ করার মধ্য দিয়ে বিদেশিদের ‘নাগরিকত্ব’ দেওয়ার ব্যাপারটিকে ধরতে হবে ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে।
মোট কথা, পেনরা ফ্রান্সকে ভয়তাড়িত একটি সমাজে পরিণত করে রাজনৈতিক কৌশল হাসিল করতে চাইছেন। এটা বিশ্বব্যাপী নরম, গরম ও ছদ্মবেশী ডানপন্থীদের পুরোনো কৌশল। এই কৌশলের অংশ হিসেবে অবিরাম প্রচার করতে থাকা হয় যে মূলধারা তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি বা ধর্মের লোকেরা সংখ্যালঘুদের (দেশভেদে এটা হতে পারে ধর্মীয়, জাতিগত বা অভিবাসী) কারণেই দুর্গতির শিকার হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। হাতের কাছে বর্তমানের কোনো উদাহরণ না থাকলে অতীত খুঁড়ে কোনো একটা নজির বের করে সংখ্যাগুরুদের তাতানো হয়; একই সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে আরও খারাপ অবস্থা হবে বলেও ভীতি ছড়ানো হয়। ফ্রান্সের মতো দেশগুলোতে অভিবাসীদের কারণেই আবহমান ‘ফরাসি জীবনযাত্রা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার’ বিলাপ করা হয়।
সাধারণ পরিস্থিতিতে হয়তো এসবে তেমন কিছু এসে যায় না; কেননা, ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলো গরিব দেশের এলিট বুদ্ধিজীবীদের যুক্তির বহর ও দাবি-দাওয়া ছাড়াই সস্তা শ্রমের সুযোগ নেওয়া এবং কায়িক পরিশ্রমের কাজগুলো করানোর জন্য গরিব দেশগুলো থেকে দক্ষ ও কম দক্ষ লোকজন নিতে বাধ্য। সুতরাং কিছু উগ্র জাতীয়তাবাদী বা ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের আস্ফাালনে উদারনীতিকেরা তেমন গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু এখন সময়টা খারাপ। অর্থনৈতিক মন্দার বছরগুলোতে ফ্রান্সের শ্রমজীবীদের অবস্থা সত্যি খারাপ। কাজ নেই হয়ে যাচ্ছে, কাজ কমে যাচ্ছে, কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যার পরিণতিতে মৌলিক চাহিদা পূরণে সমস্যা না হলেও জীবন উপভোগের নিত্য-উপচারগুলোতে টান পড়ে যাচ্ছে সাংঘাতিক। এমন একটা অবস্থারই সুযোগ নিচ্ছে উগ্র ডানরা। তারা ফরাসি শ্রমজীবীদের বলছে, অভিবাসীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা করতে গিয়েই সরকার তাদের জন্য কিছু করতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং সামনে এই ব্যর্থতা আরও প্রকট হবে। শ্রমজীবীদের মধ্যে মিথ্যা করে একটি ‘নিপীড়িতের’ বোধ প্রকট করা হচ্ছে এবং এই ‘নিপীড়িত’ হওয়ার পেছনে মূলত ‘শিথিল অভিবাসন’ব্যবস্থা দায়ী বলেই অনেক দিন থেকেই প্রচারণা চালাচ্ছে পেনরা।
প্রথম দফার ভোটের ফল বলছে, পেনদের কৌশল কাজ দিচ্ছে। মূলত অভাবী দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসীদের দিকে শ্রমজীবী ফরাসিদের তারা ভালোভাবেই লেলিয়ে দিতে পেরেছে। ফ্রন্ট ন্যাশনালে মোট ভোট পেয়েছে সাড়ে ছয় মিলিয়নের মতো। এর মধ্যে বেশির ভাগ ভোট যাদের কাছ থেকে এসেছে তারা হচ্ছে দরিদ্র, অস্থায়ী শ্রমিক, আয়-রোজগারের সুযোগ কম এমন গ্রামাঞ্চল ও শহরের উপকণ্ঠে বাসকারী, সাবেক শিল্পাঞ্চলের বাসিন্দা। এসব ভোটার প্রথাগতভাবে বামপন্থীদের ভোট দেয়; এবার ঘটেছে ব্যতিক্রম। নতুন ভোটারদের কাছ থেকেও ভালো সাড়া পেয়েছে পেনের দল। তার মানে হচ্ছে নবীন প্রজন্মের একটি অংশও যাবতীয় দুর্গতির জন্য অভিবাসীদেরই দায়ী করার শিক্ষা নিচ্ছে।
জনমত জরিপগুলোতে এবার ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদকেই জয়ী দেখা যাচ্ছিল। প্রথম দফাতে তার প্রতিফলন ঘটলেও দ্বিতীয় দফায় জান বাজি রাখবেন সারকোজি। তিনি পেনের ভোটগুলো নিজের দিকে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তিনি বলতে শুরু করে দিয়েছেন যে ফ্রন্ট ন্যাশনালের কথা শুনতেই হবে। তবে সারকোজি সম্ভবত পেনের ভোটারদের সব ভোট পাবেন না। কেননা, রক্ষণশীল সারকোজিকে এরা যথেষ্ট মাত্রার ডানপন্থী মনে করে না। আর পেনও সম্ভবত সারকোজিকে জেতাতে চাইবেন না। মে মাসের প্রথম দিন পেন ভাষণ দেবেন; তখন সব স্পষ্ট হবে। তবে সমাজতন্ত্রী ওলাঁদ জিতলেও পেনের লাভ। সারকোজির রাজনৈতিক কবরের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি তখন ফরাসি ডানপন্থার একচ্ছত্র নেতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ পাবেন। একই সঙ্গে উদারনীতিক ও বামপন্থীরা অভিবাসীদের বেশি সুযোগ দেয়, এই কথা বিরামহীন বলে-বলে গড় ফরাসিদের মন আরও বিষিয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবেন, যা তাকে ভবিষ্যতের নির্বাচনে ফায়দা দেবে। ন্যাশনাল ফ্রন্টের কথা বাদ দিলেও ওলাঁদের জেতার ভালো সম্ভাবনা আছে। প্রথম দফাতে লেফট পার্টির জাঁ লুক মেলেঁশো ১১ ভাগ ভোট পেয়েছেন; এঁরা সারকোজির পুনর্নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার ভয়ে ওলাঁদকে ভোট দিতে পারে। আরও আছে রাজনীতিতে উদাসীন ও রাজনীতিতে বিতৃষ্ণ মুক্তমনা-উদারমনস্ক লোকজন; এরা সারকোজিকে ঠেকাতে আলস্য-উদাসীনতা ত্যাগ করে ভোট দিতে আসতে পারে। এসব বিবেচনায় নিলে সারকোজি শেষ। কিন্তু পেনদের হাত থেকে বাঁচতে পারবেন না ওলাঁদ। কেননা, অর্থনৈতিক কোনো জাদু তিনি ক্ষমতাতে এসেই দেখাতে পারবেন না; অতএব শ্রমজীবী ফরাসিদের মন-দিলও শান্ত হয়ে উঠবে না। ফলে পেনদের জন্য পড়ে থাকবে ‘ভিকটিমহুড’ প্রচারের উর্বর ক্ষেত্র। পেন বলেছেন, ‘ফ্রাস আর আগের মতো থাকবে না।’ মন্দার টান না কমলে মনে হচ্ছে পেনের আস্ফাালনই সত্য হয়ে যাবে; বিশ্বের চোখে চেনা ফ্রান্স অনেকটাই বদলে যাবে।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক।
এটা এখন স্পষ্ট যে ন্যাশনাল সমর্থকদের মতিগতির ওপরই আগামী ৬ মে অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় দফার ভোটের ফলাফল অনেকাংশে নির্ভর করবে। সাদা চোখে মনে হতে পারে, একটা দল প্রথম দফার ভোটে তৃতীয় হয়েছে এবং দ্বিতীয় দফার ওপরে তাদের সমর্থনের প্রভাব থাকছে, তাতে কী হয়েছে? আসলে অনেক কিছুই হয়ে গেছে। বলতে কি ‘একটা ভূত’ এখন ইউরোপের উদারনীতিকদের তাড়া করছে, উগ্র ডানপন্থার ভূত। এই ভূত ভিন্ন জাতি, ভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষ, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন সংস্কৃতিবিদ্বেষী এবং এই ভূতের সমর্থন বাড়ছে শ্রমজীবী শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে। ফ্রন্ট ন্যাশনালে এই ভূতের ফরাসি সংস্করণ বলা চলে। পেনের দল অভিবাসন ও অভিবাসীদের চরম বিরোধী, অভিবাসন ঠেকানোর জন্য সীমান্তে কঠোরতম নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার দাবিদার। ফরাসিদের জীবনমান নেমে যাওয়ার পেছনে অভিবাসীদেরই এরা দায়ী করতে চায়; আর মনে করে যে সারকোজি নিজে একজন রক্ষণশীল হয়েও সাবেক উপনিবেশসহ গরিব দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসনের স্রোত ঠেকানো তো দূরের কথা, যারা ঢুকে পড়ার পরে ধরা পড়েছে, তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছেন। ফ্রন্ট ন্যাশনালের বক্তব্য হচ্ছে, অভিবাসীদের হাত থেকে বাঁচার প্রয়োজনে ফ্রান্সকে ২২টি ইউরোপীয় ও তিনটি অ-ইউরোপীয় দেশের সমন্বয়ে গঠিত শেনজেন এলাকা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। উল্লেখ্য, শেনজেনভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণের জন্য যেসব দেশের নাগরিকদের ভিসা প্রয়োজন হয়, তারা যেকোনো একটি দেশের ভিসা সংগ্রহ করলেই চলে। ফ্রন্ট ন্যাশনালে ‘দ্বৈত নাগরিকত্ব’ ব্যবস্থারও বিরোধী। তাদের কথা হচ্ছে, যে লোকগুলো ফ্রান্সের নাগরিকত্ব পাওয়ার পরও ছেড়ে আসা দেশের নাগরিকত্ব রেখে দেয় তারা আসলে ফ্রান্সের প্রতি কখনোই প্রকৃত অর্থে নিবেদিতপ্রাণ হয় না। এদের কথা হচ্ছে ‘ন্যাশনালিটি’ জন্মগত বিষয়, অতএব ‘ন্যাচারালাইজেশন’ করার মধ্য দিয়ে বিদেশিদের ‘নাগরিকত্ব’ দেওয়ার ব্যাপারটিকে ধরতে হবে ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে।
মোট কথা, পেনরা ফ্রান্সকে ভয়তাড়িত একটি সমাজে পরিণত করে রাজনৈতিক কৌশল হাসিল করতে চাইছেন। এটা বিশ্বব্যাপী নরম, গরম ও ছদ্মবেশী ডানপন্থীদের পুরোনো কৌশল। এই কৌশলের অংশ হিসেবে অবিরাম প্রচার করতে থাকা হয় যে মূলধারা তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি বা ধর্মের লোকেরা সংখ্যালঘুদের (দেশভেদে এটা হতে পারে ধর্মীয়, জাতিগত বা অভিবাসী) কারণেই দুর্গতির শিকার হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। হাতের কাছে বর্তমানের কোনো উদাহরণ না থাকলে অতীত খুঁড়ে কোনো একটা নজির বের করে সংখ্যাগুরুদের তাতানো হয়; একই সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে আরও খারাপ অবস্থা হবে বলেও ভীতি ছড়ানো হয়। ফ্রান্সের মতো দেশগুলোতে অভিবাসীদের কারণেই আবহমান ‘ফরাসি জীবনযাত্রা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার’ বিলাপ করা হয়।
সাধারণ পরিস্থিতিতে হয়তো এসবে তেমন কিছু এসে যায় না; কেননা, ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলো গরিব দেশের এলিট বুদ্ধিজীবীদের যুক্তির বহর ও দাবি-দাওয়া ছাড়াই সস্তা শ্রমের সুযোগ নেওয়া এবং কায়িক পরিশ্রমের কাজগুলো করানোর জন্য গরিব দেশগুলো থেকে দক্ষ ও কম দক্ষ লোকজন নিতে বাধ্য। সুতরাং কিছু উগ্র জাতীয়তাবাদী বা ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের আস্ফাালনে উদারনীতিকেরা তেমন গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু এখন সময়টা খারাপ। অর্থনৈতিক মন্দার বছরগুলোতে ফ্রান্সের শ্রমজীবীদের অবস্থা সত্যি খারাপ। কাজ নেই হয়ে যাচ্ছে, কাজ কমে যাচ্ছে, কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যার পরিণতিতে মৌলিক চাহিদা পূরণে সমস্যা না হলেও জীবন উপভোগের নিত্য-উপচারগুলোতে টান পড়ে যাচ্ছে সাংঘাতিক। এমন একটা অবস্থারই সুযোগ নিচ্ছে উগ্র ডানরা। তারা ফরাসি শ্রমজীবীদের বলছে, অভিবাসীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা করতে গিয়েই সরকার তাদের জন্য কিছু করতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং সামনে এই ব্যর্থতা আরও প্রকট হবে। শ্রমজীবীদের মধ্যে মিথ্যা করে একটি ‘নিপীড়িতের’ বোধ প্রকট করা হচ্ছে এবং এই ‘নিপীড়িত’ হওয়ার পেছনে মূলত ‘শিথিল অভিবাসন’ব্যবস্থা দায়ী বলেই অনেক দিন থেকেই প্রচারণা চালাচ্ছে পেনরা।
প্রথম দফার ভোটের ফল বলছে, পেনদের কৌশল কাজ দিচ্ছে। মূলত অভাবী দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসীদের দিকে শ্রমজীবী ফরাসিদের তারা ভালোভাবেই লেলিয়ে দিতে পেরেছে। ফ্রন্ট ন্যাশনালে মোট ভোট পেয়েছে সাড়ে ছয় মিলিয়নের মতো। এর মধ্যে বেশির ভাগ ভোট যাদের কাছ থেকে এসেছে তারা হচ্ছে দরিদ্র, অস্থায়ী শ্রমিক, আয়-রোজগারের সুযোগ কম এমন গ্রামাঞ্চল ও শহরের উপকণ্ঠে বাসকারী, সাবেক শিল্পাঞ্চলের বাসিন্দা। এসব ভোটার প্রথাগতভাবে বামপন্থীদের ভোট দেয়; এবার ঘটেছে ব্যতিক্রম। নতুন ভোটারদের কাছ থেকেও ভালো সাড়া পেয়েছে পেনের দল। তার মানে হচ্ছে নবীন প্রজন্মের একটি অংশও যাবতীয় দুর্গতির জন্য অভিবাসীদেরই দায়ী করার শিক্ষা নিচ্ছে।
জনমত জরিপগুলোতে এবার ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদকেই জয়ী দেখা যাচ্ছিল। প্রথম দফাতে তার প্রতিফলন ঘটলেও দ্বিতীয় দফায় জান বাজি রাখবেন সারকোজি। তিনি পেনের ভোটগুলো নিজের দিকে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তিনি বলতে শুরু করে দিয়েছেন যে ফ্রন্ট ন্যাশনালের কথা শুনতেই হবে। তবে সারকোজি সম্ভবত পেনের ভোটারদের সব ভোট পাবেন না। কেননা, রক্ষণশীল সারকোজিকে এরা যথেষ্ট মাত্রার ডানপন্থী মনে করে না। আর পেনও সম্ভবত সারকোজিকে জেতাতে চাইবেন না। মে মাসের প্রথম দিন পেন ভাষণ দেবেন; তখন সব স্পষ্ট হবে। তবে সমাজতন্ত্রী ওলাঁদ জিতলেও পেনের লাভ। সারকোজির রাজনৈতিক কবরের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি তখন ফরাসি ডানপন্থার একচ্ছত্র নেতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ পাবেন। একই সঙ্গে উদারনীতিক ও বামপন্থীরা অভিবাসীদের বেশি সুযোগ দেয়, এই কথা বিরামহীন বলে-বলে গড় ফরাসিদের মন আরও বিষিয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবেন, যা তাকে ভবিষ্যতের নির্বাচনে ফায়দা দেবে। ন্যাশনাল ফ্রন্টের কথা বাদ দিলেও ওলাঁদের জেতার ভালো সম্ভাবনা আছে। প্রথম দফাতে লেফট পার্টির জাঁ লুক মেলেঁশো ১১ ভাগ ভোট পেয়েছেন; এঁরা সারকোজির পুনর্নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার ভয়ে ওলাঁদকে ভোট দিতে পারে। আরও আছে রাজনীতিতে উদাসীন ও রাজনীতিতে বিতৃষ্ণ মুক্তমনা-উদারমনস্ক লোকজন; এরা সারকোজিকে ঠেকাতে আলস্য-উদাসীনতা ত্যাগ করে ভোট দিতে আসতে পারে। এসব বিবেচনায় নিলে সারকোজি শেষ। কিন্তু পেনদের হাত থেকে বাঁচতে পারবেন না ওলাঁদ। কেননা, অর্থনৈতিক কোনো জাদু তিনি ক্ষমতাতে এসেই দেখাতে পারবেন না; অতএব শ্রমজীবী ফরাসিদের মন-দিলও শান্ত হয়ে উঠবে না। ফলে পেনদের জন্য পড়ে থাকবে ‘ভিকটিমহুড’ প্রচারের উর্বর ক্ষেত্র। পেন বলেছেন, ‘ফ্রাস আর আগের মতো থাকবে না।’ মন্দার টান না কমলে মনে হচ্ছে পেনের আস্ফাালনই সত্য হয়ে যাবে; বিশ্বের চোখে চেনা ফ্রান্স অনেকটাই বদলে যাবে।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক।