যাঁরা সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রদেহে বিদ্যমান যাবতীয় সমস্যা সমাধানের খোয়াব দেখেন, তাঁরা ধন্য। এ ধরনের লোক কম নেই বাংলাদেশে। সংসদীয় গণতন্ত্র তার ইতিহাসে যেসব বিষয়ে কখনো কোনো অঙ্গীকার করেনি, সেসব দিকেও আমাদের আশাবাদের ঘোড়াটিকে পরোক্ষে তাড়িত করেন এসব লোক। কেন, কে জানে! কথায় কথায় সংসদীয় গণতন্ত্র, সংসদীয় গণতন্ত্র! সমস্যা দেখলেই সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যর্থতা! কদাচ সাফল্যের দেখা পেলে সংসদীয় গণতন্ত্রের অবদান! অতিরিক্ত ব্যবহার আর অযথা প্রত্যাশার চাপে পড়ে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সম্ভাবনার দিকটি আজ বহুলাংশেই কতগুলো নিয়ম-কানুনসর্বস্ব শাস্ত্র-বচনে পর্যবসিত; আর চর্চার ক্ষেত্রের সীমাহীন ব্যর্থতার প্রসঙ্গটি আলোচনাই অর্থহীন।
‘স্বপ্নের জাতীয় সংসদ’ ভাবনাটির সঙ্গে এই প্রবন্ধকারের ভিন্নমত আছে; এই প্রবন্ধকারের মতে, সংসদীয় ব্যবস্থা কখনো ‘স্বপ্নের মতো সুন্দর’ হতে পারে না।
কারণ? সংসদীয় গণতন্ত্র বৈষম্যনির্ভর ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে পারে কি? ছোটলোকবান্ধব ব্যবস্থা কার্যকর করতে পারে? পারে কি উপহার দিতে সাম্য, যা দ্বারা মানুষ অন্যান্য জীবের তুলনায় নিজেকে প্রমাণ করতে পারে শ্রেষ্ঠতর? পারে না। অতীতে কোথাও পারেনি, এখনো পারে না। ১৮৩২ সালে যখন গ্রেট রিফর্ম অ্যাক্টের মধ্য দিয়ে ব্রিটেনে পার্লামেন্টারি-ব্যবস্থার একাধিপত্য চূড়ান্ত হয়, তখন থেকে হিসাব ধরলে কিংবা ফ্রান্সে ১৮৭০ সালে সূচিত হওয়া সাত দশক দীর্ঘ ফরাসি পার্লামেন্টারি-ব্যবস্থার স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত থার্ড রিপাবলিকের ইতিহাসের দিকে তাকালেও একই উত্তর পাওয়া যাবে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলে এর ব্যতিক্রম ঘটবে, তা মনে করার কোনো কারণ অতীত বা বর্তমানে একেবারেই ঘটেনি।
ব্রিটিশ কলোনিকালে শাসনতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক এলিটদের শাসনব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বের দাবিদাওয়া আর সংগ্রামের ইতিহাস কী বলে? ১৯০৮ সালের মর্লি-মিন্টো অ্যাক্ট, ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড অ্যাক্ট কিংবা ১৯৩৫ সালের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট কী বলে? বলে এই কথাটিই যে উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক এলিটরা শাসনের শৃঙ্খল শিথিল করতে চেয়েছেন, এলিটরা শাসন প্রণালির মধ্যে জনগণের নামে আসলে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব দেখতে চেয়েছেন। দীর্ঘমেয়াদি নানা রাজনৈতিক ধস্তাধস্তির পরে ঔপনিবেশিক প্রভুরা এসব অ্যাক্টের মধ্য দিয়ে সামান্য মাত্রার যে ছাড়গুলো দিতেন, সেগুলোতে প্রতিনিধিত্ব বলতে মূলত এলিটদের প্রতিনিধিত্ব বোঝাত। পরবর্তী পর্যায়েও দেখা যাবে একই চিত্র।
পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ অর্জনের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে একটি প্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থার স্বপ্ন যুক্ত ছিল, এটা ঠিক। কিন্তু মূলত জাতীয়তাবাদের রাজনীতিনির্ভর এই আন্দোলন-সংগ্রাম পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালিদের শাসন-শোষণ অবসানের বিরোধিতাকে মূল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলেও শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতার কারণে বৈষম্য অবসানের প্রশ্নটিকে কখনোই প্রধান করে তোলেনি। সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসকে উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর সঙ্গে যুক্ত করে বিবেচনায় নিলে সংসদীয় ব্যবস্থা তথা জাতীয় সংসদ একদিন না একদিন ‘স্বপ্নের মতো সুন্দর’ হয়ে উঠবে—এমনটি মনে করা মুশকিল।
তাই বলে কি সংসদীয় ব্যবস্থা তথা জাতীয় সংসদ নিয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই? অবশ্যই আছে; তবে এই বক্তব্য অবশ্যই সংসদীয় ব্যবস্থার সাধ্যের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে। কোনো লাভ নেই ‘আশার ছলনে ভুলি’। এমতাবস্থায় আলোচ্য হচ্ছে এমন একটি সংসদ, ‘যা হয়তো আমরা বর্তমানে পাই না, কিন্তু যা আমরা পেতে চাই’। প্রসঙ্গত, আরও বিবেচ্য, আমরা ‘কেমন জাতীয় সংসদ দেখতে চাই’। বুর্জোয়া প্রাধান্যাধীন সংসদীয় শাসন প্রণালিতে সাম্য, অসাম্য, বৈষম্যের মতো বিষয়গুলোর ফয়সালা হয়ে যাবে—এমন উচ্চাশা পোষণ না করাটাই যৌক্তিক। তাই আমরা দেখতে চাই এমন একটি জাতীয় সংসদ, যা বৈষম্য নির্মূলে ভূমিকা না রাখতে পারলেও দারিদ্র্যবিমোচনে সক্ষম।
গুলিয়ে ফেলা যাবে না; বৈষম্যের অবসান আর গরিবি হটানো এক কথা নয়। গরিবির অবসান হলেই বৈষম্যের অবসান হয় না। পশ্চিমের ধনী দেশগুলো দারিদ্র্যপীড়িত নয়, কিন্তু নিদারুণ মাত্রায় বৈষম্যে আক্রান্ত। বৈষম্য অবসানের রাজনীতি তথা তরিকা ভিন্ন এবং এটি মানবেতিহাসের অগ্রগতিমুখীন অনেক বড় একটি প্রকল্প; সংসদীয় ব্যবস্থার সাধ্য নেই সেই পথে হাঁটার। শ্রেণীগত কারণেই সংসদীয় রাজনীতির মধ্য দিয়ে এটি অর্জন করা সম্ভব নয়। কিন্তু বুর্জোয়া ব্যবস্থাধীন সংসদীয় প্রণালির মধ্যে থেকেই দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব; পশ্চিম ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর ইতিহাস তা-ই বলে। স্বাধীনতার চার দশক হয়ে গেল; দারিদ্র্যবিমোচনের মতো একটি কাজ সম্পন্ন করাতে এত দেরি কেন বাংলাদেশে? সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান খুঁজতে চাওয়া লোকজনের এ প্রসঙ্গে ভাবা দরকার।
সেনা-নিয়ন্ত্রিত এক-এগারোর বছর দুয়েকসহ সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দুই দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনো কথায় কথায় সামরিক আমলে রাষ্ট্রযন্ত্রের যে বড় ক্ষতিগুলো করা হয়েছে, সেগুলোর দোহাই পাড়লে চলবে কেন? যদিও এ কথা সত্য যে সেনাপতিদের শাসনামলে সৃষ্ট বৈশ্বিক পুঁজিবাদের দাসানুদাস হিসেবে মালপানি কামাই করা এবং এখন অবধি মানসিকতার দিক থেকে সামন্তবাদী থেকে যাওয়া বিকটমূর্তি লুম্পেন বণিকেরাই এখন বাংলাদেশের নিয়ন্তা। জাতীয় সংসদকে খিস্তিখেউড়ের আখড়া বানিয়ে ফেলা থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীনদের যথেচ্ছাচার আর সংসদীয় অধিকারের নামে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ অব্যাহত রেখেই প্রধান বিরোধী দলের টানা সংসদ বর্জনের মতো অরাজকতার মধ্যে বাংলাদেশের অধিপতি শ্রেণীটির চরিত্র সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে।
প্রসঙ্গত, বর্তমান জাতীয় সংসদ সদস্যদের ৫৬ শতাংশ হচ্ছেন বণিক; এঁরা আসলে বড় বণিক বা অতি বড় বণিক। আমরা চাই বাংলাদেশের বুর্জোয়ারা প্রকৃত অর্থে বুর্জোয়া হয়ে উঠুক। অতি সস্তা শ্রমের দাস-মালিকসুলভ ব্যবহার, কমিশনবাজি, টেন্ডারবাজি করে কার্যত ঝুঁকিহীন মুফতে কামাইয়ের জোরে রমারমা লুম্পেন বুর্জোয়ার জায়গায় জাতীয় বুর্জোয়ার উদ্ভব ঘটুক। বর্তমান বিশ্ব-বাস্তবতায় তা আদৌ সম্ভব কি না, বলা মুশকিল; কিন্তু সংসদীয় ব্যবস্থায় ভদ্রলোকিয়ানা এবং গণমানুষের স্বার্থের কিছু মাত্রার প্রতিফলন দেখাতে হলে অধিপতি শ্রেণীটির সত্যিকারের বুর্জোয়া হয়ে ওঠার বিকল্প নেই।
সুশীল সমাজ, থিংক ট্যাংকের কথামালা কিংবা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সুশীল সাংসদ তৈরির চেষ্টা খুব একটা কাজে আসবে বলে মনে হয় না। বরং সত্যিকারের বুর্জোয়ার উদ্ভব ঘটলে এর প্রতিফলন অর্থনীতির হাত ধরে অবধারিতভাবে রাজনীতিতে পড়বে, এমত আশাবাদের ভিত্তি আছে। এই বুর্জোয়ারা শ্রেণীস্বার্থেই সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে সচেষ্ট হবে; তাদের খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট হবে, যাতে করে দীর্ঘ মেয়াদে শ্রম শোষণ করে নিয়মবদ্ধ উপায়ে মুনাফা করা যায়। সামন্তবাদের তুলনায় পুঁজিবাদ এই জায়গাটিতে উন্নত। সামন্তপ্রভু তাঁর প্রজাকে যথেচ্ছ শোষণ করে স্বল্পতম সময়ে সর্বোচ্চ রস নিংড়ে নেওয়ার কায়দা করে; নিজেদের বানানো আইন নিজেরাই যখন-তখন মাড়ায়। পক্ষান্তরে ‘ভালো’ বুর্জোয়ারা বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি না হলে এ রকম করে না। বরং মানবিক মুখোশ পরিয়ে আইনকানুন, নিয়ম-নির্দেশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ সংস্থাগুলো তথা রাষ্ট্রযন্ত্রকে বুর্জোয়াদের উপযোগী করে সাজিয়ে নেয়।
জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার; জাতির স্বার্থের নাম করে বড়লোকের স্বার্থ দেখাটাই হচ্ছে স্বাভাবিকতা; অন্য কিছু স্বপ্ন দেখা বা দেখানোটাই হচ্ছে অস্বাভাবিকতা। ‘কেমন জাতীয় সংসদ দেখতে চাই বা পেতে চাই’ শীর্ষক জিজ্ঞাসার একটি জবাব হচ্ছে, আমরা প্রকৃত বুর্জোয়াদের প্রাধান্য বা প্রতিনিধিত্বশীল একটি জাতীয় সংসদ চাই; অর্থাৎ যে শ্রেণীর হাত ধরে সংসদীয় ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে, ইতিহাসে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আমরা সেই শ্রেণীটির প্রাধান্য বা প্রতিনিধিত্ব দেখতে চাই।
আমরা এমন একটি সংসদীয় শাসনব্যবস্থা দেখতে চাই, যাতে সরকারি ও বিরোধীদলীয় সাংসদেরা উপরিতলে বিরাজমান বিভেদটুকু ভুলে গিয়ে মেহগনি, শুল্কমুক্ত গাড়ি, জমি-ফ্ল্যাট বরাদ্দ কিংবা ভাতা বৃদ্ধির প্রশ্নে একযোগে তৎপর থাকবে না। আমরা এমন একটি সংসদীয় রাজনীতি চাই, যা সমতা আনতে না পারুক, জনসাধারণের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। এমন একটি সংসদীয় ব্যবস্থার আশা পোষণ করা কি অন্যায় হবে, যে ব্যবস্থা নয়া উদারনৈতিক তাত্ত্বিক কাঠামোর ভয়াবহতা অনুধাবন করতে একে ছুড়ে ফেলে দিতে সক্ষম?
আর্থসামাজিক পরিস্থিতি অনুযায়ী ভূমি সংস্কার, ব্যাটাতন্ত্রের প্রকোপ হ্রাস, সাধারণ শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ, সেনায়িত সমাজে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নির্মূল করা, ধর্মীয় উগ্রবাদের অবসান ঘটানোর মতো কাজগুলো সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অধীনে থেকেই সম্পন্ন করা সম্ভব। অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে এসব মিশন অনেক আগেই সম্পন্ন হয়েছে। বৈষম্য অবসানের মতো বিশাল দায়িত্ব নয়, ন্যূনতম সম্মানের সঙ্গে মানুষের বেঁচে-বর্তে থাকার স্বার্থে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতি উল্লিখিত কাজগুলো সম্পন্ন করুক—এটুকুই প্রত্যাশা।
প্রথম আলোর গতবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ‘বাকবাকুম’ শুনতে পাওয়ার কথা লিখেছিলাম। প্রকৃত প্রস্তাবে অর্থহীন; শুধুই গলা ফুলানো কথাবার্তা। মূলধারার রাজনীতিতে গত এক বছরে গণতন্ত্র প্রসঙ্গে ‘বাকবাকুম’ উপমা ব্যবহার ভুলিয়ে দেওয়ার মতো এতটুকু অগ্রগতি ঘটেছে বলে মনে হয় না। বরং অবস্থাদৃষ্টে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে উচ্চাশা তো নয়ই, কিছু প্রত্যাশা রাখতেও অনীহা জাগে।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
‘স্বপ্নের জাতীয় সংসদ’ ভাবনাটির সঙ্গে এই প্রবন্ধকারের ভিন্নমত আছে; এই প্রবন্ধকারের মতে, সংসদীয় ব্যবস্থা কখনো ‘স্বপ্নের মতো সুন্দর’ হতে পারে না।
কারণ? সংসদীয় গণতন্ত্র বৈষম্যনির্ভর ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে পারে কি? ছোটলোকবান্ধব ব্যবস্থা কার্যকর করতে পারে? পারে কি উপহার দিতে সাম্য, যা দ্বারা মানুষ অন্যান্য জীবের তুলনায় নিজেকে প্রমাণ করতে পারে শ্রেষ্ঠতর? পারে না। অতীতে কোথাও পারেনি, এখনো পারে না। ১৮৩২ সালে যখন গ্রেট রিফর্ম অ্যাক্টের মধ্য দিয়ে ব্রিটেনে পার্লামেন্টারি-ব্যবস্থার একাধিপত্য চূড়ান্ত হয়, তখন থেকে হিসাব ধরলে কিংবা ফ্রান্সে ১৮৭০ সালে সূচিত হওয়া সাত দশক দীর্ঘ ফরাসি পার্লামেন্টারি-ব্যবস্থার স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত থার্ড রিপাবলিকের ইতিহাসের দিকে তাকালেও একই উত্তর পাওয়া যাবে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলে এর ব্যতিক্রম ঘটবে, তা মনে করার কোনো কারণ অতীত বা বর্তমানে একেবারেই ঘটেনি।
ব্রিটিশ কলোনিকালে শাসনতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক এলিটদের শাসনব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বের দাবিদাওয়া আর সংগ্রামের ইতিহাস কী বলে? ১৯০৮ সালের মর্লি-মিন্টো অ্যাক্ট, ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড অ্যাক্ট কিংবা ১৯৩৫ সালের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট কী বলে? বলে এই কথাটিই যে উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক এলিটরা শাসনের শৃঙ্খল শিথিল করতে চেয়েছেন, এলিটরা শাসন প্রণালির মধ্যে জনগণের নামে আসলে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব দেখতে চেয়েছেন। দীর্ঘমেয়াদি নানা রাজনৈতিক ধস্তাধস্তির পরে ঔপনিবেশিক প্রভুরা এসব অ্যাক্টের মধ্য দিয়ে সামান্য মাত্রার যে ছাড়গুলো দিতেন, সেগুলোতে প্রতিনিধিত্ব বলতে মূলত এলিটদের প্রতিনিধিত্ব বোঝাত। পরবর্তী পর্যায়েও দেখা যাবে একই চিত্র।
পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ অর্জনের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে একটি প্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থার স্বপ্ন যুক্ত ছিল, এটা ঠিক। কিন্তু মূলত জাতীয়তাবাদের রাজনীতিনির্ভর এই আন্দোলন-সংগ্রাম পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালিদের শাসন-শোষণ অবসানের বিরোধিতাকে মূল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলেও শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতার কারণে বৈষম্য অবসানের প্রশ্নটিকে কখনোই প্রধান করে তোলেনি। সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসকে উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর সঙ্গে যুক্ত করে বিবেচনায় নিলে সংসদীয় ব্যবস্থা তথা জাতীয় সংসদ একদিন না একদিন ‘স্বপ্নের মতো সুন্দর’ হয়ে উঠবে—এমনটি মনে করা মুশকিল।
তাই বলে কি সংসদীয় ব্যবস্থা তথা জাতীয় সংসদ নিয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই? অবশ্যই আছে; তবে এই বক্তব্য অবশ্যই সংসদীয় ব্যবস্থার সাধ্যের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে। কোনো লাভ নেই ‘আশার ছলনে ভুলি’। এমতাবস্থায় আলোচ্য হচ্ছে এমন একটি সংসদ, ‘যা হয়তো আমরা বর্তমানে পাই না, কিন্তু যা আমরা পেতে চাই’। প্রসঙ্গত, আরও বিবেচ্য, আমরা ‘কেমন জাতীয় সংসদ দেখতে চাই’। বুর্জোয়া প্রাধান্যাধীন সংসদীয় শাসন প্রণালিতে সাম্য, অসাম্য, বৈষম্যের মতো বিষয়গুলোর ফয়সালা হয়ে যাবে—এমন উচ্চাশা পোষণ না করাটাই যৌক্তিক। তাই আমরা দেখতে চাই এমন একটি জাতীয় সংসদ, যা বৈষম্য নির্মূলে ভূমিকা না রাখতে পারলেও দারিদ্র্যবিমোচনে সক্ষম।
গুলিয়ে ফেলা যাবে না; বৈষম্যের অবসান আর গরিবি হটানো এক কথা নয়। গরিবির অবসান হলেই বৈষম্যের অবসান হয় না। পশ্চিমের ধনী দেশগুলো দারিদ্র্যপীড়িত নয়, কিন্তু নিদারুণ মাত্রায় বৈষম্যে আক্রান্ত। বৈষম্য অবসানের রাজনীতি তথা তরিকা ভিন্ন এবং এটি মানবেতিহাসের অগ্রগতিমুখীন অনেক বড় একটি প্রকল্প; সংসদীয় ব্যবস্থার সাধ্য নেই সেই পথে হাঁটার। শ্রেণীগত কারণেই সংসদীয় রাজনীতির মধ্য দিয়ে এটি অর্জন করা সম্ভব নয়। কিন্তু বুর্জোয়া ব্যবস্থাধীন সংসদীয় প্রণালির মধ্যে থেকেই দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব; পশ্চিম ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর ইতিহাস তা-ই বলে। স্বাধীনতার চার দশক হয়ে গেল; দারিদ্র্যবিমোচনের মতো একটি কাজ সম্পন্ন করাতে এত দেরি কেন বাংলাদেশে? সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান খুঁজতে চাওয়া লোকজনের এ প্রসঙ্গে ভাবা দরকার।
সেনা-নিয়ন্ত্রিত এক-এগারোর বছর দুয়েকসহ সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দুই দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনো কথায় কথায় সামরিক আমলে রাষ্ট্রযন্ত্রের যে বড় ক্ষতিগুলো করা হয়েছে, সেগুলোর দোহাই পাড়লে চলবে কেন? যদিও এ কথা সত্য যে সেনাপতিদের শাসনামলে সৃষ্ট বৈশ্বিক পুঁজিবাদের দাসানুদাস হিসেবে মালপানি কামাই করা এবং এখন অবধি মানসিকতার দিক থেকে সামন্তবাদী থেকে যাওয়া বিকটমূর্তি লুম্পেন বণিকেরাই এখন বাংলাদেশের নিয়ন্তা। জাতীয় সংসদকে খিস্তিখেউড়ের আখড়া বানিয়ে ফেলা থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীনদের যথেচ্ছাচার আর সংসদীয় অধিকারের নামে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ অব্যাহত রেখেই প্রধান বিরোধী দলের টানা সংসদ বর্জনের মতো অরাজকতার মধ্যে বাংলাদেশের অধিপতি শ্রেণীটির চরিত্র সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে।
প্রসঙ্গত, বর্তমান জাতীয় সংসদ সদস্যদের ৫৬ শতাংশ হচ্ছেন বণিক; এঁরা আসলে বড় বণিক বা অতি বড় বণিক। আমরা চাই বাংলাদেশের বুর্জোয়ারা প্রকৃত অর্থে বুর্জোয়া হয়ে উঠুক। অতি সস্তা শ্রমের দাস-মালিকসুলভ ব্যবহার, কমিশনবাজি, টেন্ডারবাজি করে কার্যত ঝুঁকিহীন মুফতে কামাইয়ের জোরে রমারমা লুম্পেন বুর্জোয়ার জায়গায় জাতীয় বুর্জোয়ার উদ্ভব ঘটুক। বর্তমান বিশ্ব-বাস্তবতায় তা আদৌ সম্ভব কি না, বলা মুশকিল; কিন্তু সংসদীয় ব্যবস্থায় ভদ্রলোকিয়ানা এবং গণমানুষের স্বার্থের কিছু মাত্রার প্রতিফলন দেখাতে হলে অধিপতি শ্রেণীটির সত্যিকারের বুর্জোয়া হয়ে ওঠার বিকল্প নেই।
সুশীল সমাজ, থিংক ট্যাংকের কথামালা কিংবা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সুশীল সাংসদ তৈরির চেষ্টা খুব একটা কাজে আসবে বলে মনে হয় না। বরং সত্যিকারের বুর্জোয়ার উদ্ভব ঘটলে এর প্রতিফলন অর্থনীতির হাত ধরে অবধারিতভাবে রাজনীতিতে পড়বে, এমত আশাবাদের ভিত্তি আছে। এই বুর্জোয়ারা শ্রেণীস্বার্থেই সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে সচেষ্ট হবে; তাদের খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট হবে, যাতে করে দীর্ঘ মেয়াদে শ্রম শোষণ করে নিয়মবদ্ধ উপায়ে মুনাফা করা যায়। সামন্তবাদের তুলনায় পুঁজিবাদ এই জায়গাটিতে উন্নত। সামন্তপ্রভু তাঁর প্রজাকে যথেচ্ছ শোষণ করে স্বল্পতম সময়ে সর্বোচ্চ রস নিংড়ে নেওয়ার কায়দা করে; নিজেদের বানানো আইন নিজেরাই যখন-তখন মাড়ায়। পক্ষান্তরে ‘ভালো’ বুর্জোয়ারা বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি না হলে এ রকম করে না। বরং মানবিক মুখোশ পরিয়ে আইনকানুন, নিয়ম-নির্দেশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ সংস্থাগুলো তথা রাষ্ট্রযন্ত্রকে বুর্জোয়াদের উপযোগী করে সাজিয়ে নেয়।
জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার; জাতির স্বার্থের নাম করে বড়লোকের স্বার্থ দেখাটাই হচ্ছে স্বাভাবিকতা; অন্য কিছু স্বপ্ন দেখা বা দেখানোটাই হচ্ছে অস্বাভাবিকতা। ‘কেমন জাতীয় সংসদ দেখতে চাই বা পেতে চাই’ শীর্ষক জিজ্ঞাসার একটি জবাব হচ্ছে, আমরা প্রকৃত বুর্জোয়াদের প্রাধান্য বা প্রতিনিধিত্বশীল একটি জাতীয় সংসদ চাই; অর্থাৎ যে শ্রেণীর হাত ধরে সংসদীয় ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে, ইতিহাসে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আমরা সেই শ্রেণীটির প্রাধান্য বা প্রতিনিধিত্ব দেখতে চাই।
আমরা এমন একটি সংসদীয় শাসনব্যবস্থা দেখতে চাই, যাতে সরকারি ও বিরোধীদলীয় সাংসদেরা উপরিতলে বিরাজমান বিভেদটুকু ভুলে গিয়ে মেহগনি, শুল্কমুক্ত গাড়ি, জমি-ফ্ল্যাট বরাদ্দ কিংবা ভাতা বৃদ্ধির প্রশ্নে একযোগে তৎপর থাকবে না। আমরা এমন একটি সংসদীয় রাজনীতি চাই, যা সমতা আনতে না পারুক, জনসাধারণের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। এমন একটি সংসদীয় ব্যবস্থার আশা পোষণ করা কি অন্যায় হবে, যে ব্যবস্থা নয়া উদারনৈতিক তাত্ত্বিক কাঠামোর ভয়াবহতা অনুধাবন করতে একে ছুড়ে ফেলে দিতে সক্ষম?
আর্থসামাজিক পরিস্থিতি অনুযায়ী ভূমি সংস্কার, ব্যাটাতন্ত্রের প্রকোপ হ্রাস, সাধারণ শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ, সেনায়িত সমাজে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নির্মূল করা, ধর্মীয় উগ্রবাদের অবসান ঘটানোর মতো কাজগুলো সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অধীনে থেকেই সম্পন্ন করা সম্ভব। অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে এসব মিশন অনেক আগেই সম্পন্ন হয়েছে। বৈষম্য অবসানের মতো বিশাল দায়িত্ব নয়, ন্যূনতম সম্মানের সঙ্গে মানুষের বেঁচে-বর্তে থাকার স্বার্থে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতি উল্লিখিত কাজগুলো সম্পন্ন করুক—এটুকুই প্রত্যাশা।
প্রথম আলোর গতবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ‘বাকবাকুম’ শুনতে পাওয়ার কথা লিখেছিলাম। প্রকৃত প্রস্তাবে অর্থহীন; শুধুই গলা ফুলানো কথাবার্তা। মূলধারার রাজনীতিতে গত এক বছরে গণতন্ত্র প্রসঙ্গে ‘বাকবাকুম’ উপমা ব্যবহার ভুলিয়ে দেওয়ার মতো এতটুকু অগ্রগতি ঘটেছে বলে মনে হয় না। বরং অবস্থাদৃষ্টে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে উচ্চাশা তো নয়ই, কিছু প্রত্যাশা রাখতেও অনীহা জাগে।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন