শান্তনু মজুমদার
বুধবার জার্মানির স্যুডয়েচ জেইটাং পত্রিকায় ইসরায়েলি জায়নবাদের কঠোর সমালোচনাপূর্ণ ‘যে কথা বলতেই হবে’ শিরোনামের একটি কবিতা প্রকাশ করে বৃহস্পতিবার শুরুর আগেই জায়নবাদী ও জায়নবাদের সমর্থক-পৃষ্ঠপোষকদের বাক-আক্রমণের মধ্যে পড়ে গেলেন জার্মানির জীবিত লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান মুক্তবুদ্ধির লেখক গুন্টার গ্রাস (৮৪)।
গুন্টার গ্রাসের কি মতিভ্রম হয়েছে? জীবনসায়াহ্নে এসে নিজেকে এমন ঝামেলায় কেউ ফেলে? প্রধান শক্তিমান দেশ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে কী দেখা যায়? দেখা যায়, বড় দুই দলের বড় নেতারা কে কত বড় ইসরায়েল-বন্ধু সে প্রমাণে সারাক্ষণ হাস্যকরভাবে তৎপর। একজন যদি বলে যে ফিলিস্তিনিদের জেরুজালেমের ওপর থেকে দাবি তুলে নিতে হবে, আরেকজন তখন বলে ওঠে চলমান অশান্তির জন্য ফিলিস্তিনিদের গোঁয়ার্তুমিই দায়ী। পশ্চিমের মূলধারার মিডিয়াতে কী দেখা যায়? দেখা যায় যে ইরান একটা পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলতে যাচ্ছে এবং একবার যদি এই জিনিস ইরানের হাতে আসে, তাহলে আর দেখতে হবে না। কিন্তু ইসরায়েলের হাতে যে একই জিনিস অনেক দিন আগে থেকেই আছে, তা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য, আশঙ্কা পশ্চিমের মূলধারার মিডিয়াতে দেখা যায় না।
গ্রাসের নিজের দেশ জার্মানিতে কী দেখা যাচ্ছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনার ব্যাপারটি নিয়ে জার্মানরা অপরাধবোধে ভোগে। কিন্তু এই অপরাধবোধ কি ইসরায়েলের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম সাবমেরিন তুলে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত জার্মানি নিয়েছে, সে সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেয়? ‘অপরাধবোধটোধ’ কিছু নয়—আসল কথা হচ্ছে, বিশ্বমঞ্চে জায়নবাদের শক্তিমান উপস্থিতি, যা জার্মানি গ্রাহ্য করে। আর থাকে বাণিজ্য প্রসঙ্গ—ইসরায়েল হোক আর যে-ই হোক, পরমাণু অস্ত্রের হুমকি বাড়ুক কি না বাড়ুক, আসল কথা হচ্ছে অস্ত্র বেচে মুনাফা। এই যখন অবস্থা, তখন গ্রাসের কি এমন দরকার পড়ে গেল যে তিনি নিরুপদ্রব বা কল্পিত কোনো সমস্যা বা শত্রুকে বেছে না নিয়ে একেবারে জায়নবাদী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কবিতা লিখতে লেগে গেলেন?
গুন্টার গ্রাস আসলে সত্য-তাড়িত হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে নিজের মধ্যে চেপে রাখা কথাগুলো নির্ভীকে প্রকাশ করে দিয়ে মুক্ত হয়েছেন। নয়টি পঙিক্ততে বিভক্ত ৬৯ লাইন দীর্ঘ ‘যে কথা বলতেই হবে’ কবিতায় ইসরায়েলের জায়নবাদী নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন গ্রাস। ইরান একটি পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলছে এমত ধরে নিয়ে ইরানের ওপরে সামরিক হামলা চালানোর ইসরায়েলি আস্ফাালন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। গ্রাস কবিতায় লিখেননি কিন্তু আমরা জানি যে মৌলবাদী, উগ্র ডানপন্থী ও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সমর্থনপুষ্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কোয়ালিশন সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রাণভোমরাটিই হচ্ছে ফিলিস্তিন ও ইরানবিরোধী উগ্র আস্ফাালন। ধর্মগুরু শাসিত ইরানের মতো দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ইরানি পরমাণু স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করতে দেওয়া ও না-দেওয়া নিয়ে পশ্চিম ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে তেহরানের নিয়মিত বিতণ্ডার কথা আমরা জানি। কিন্তু আলোচ্য কবিতায় গ্রাস আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ইসরায়েলের পরমাণু স্থাপনা পরিদর্শনের ব্যাপারটি নিয়ে কখনো একটি কথাও হয় না।
তো, এত দিন পরে গ্রাসের কলমে কেন এসব কথা? ‘এত দিন কোথায় ছিলেন’ গ্রাস? ‘যে কথা বলতেই হবে’ কবিতাতে এ প্রশ্নটি নিজেকেই ছুড়ে দিয়েছেন গ্রাস। তাঁর ভাষায়, ‘এই বার্ধক্যে, দোয়াতের শেষ কালিটুকু দিয়ে’ কেন বলতে হচ্ছে ‘ইসরায়েলের পরমাণু সামর্থ্য ইতিমধ্যে ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া বিশ্বশান্তিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে’। ঠিক পরের লাইনেই উত্তর আছে, ‘কারণ এটা বলতেই হবে। এমনকি এটা বলার জন্য আগামীকালও হয়ে যেতে পারে ভীষণ বিলম্ব।’ ইসরায়েলকে পারমাণবিক অস্ত্রের সামর্থ্যসম্পন্ন নৌযান জোগানের মধ্য দিয়ে জার্মানির ‘একটি অপরাধের মদদদাতা’ হয়ে যাওয়ার ভয়ও গ্রাস করেছে গ্রাসকে। যুক্তির ক্ষেত্রে ভণ্ডামি পশ্চিমা শক্তিমানদের জন্য নতুন কিছু নয়। গুন্টার গ্রাস ‘পশ্চিমের ভণ্ডামিতে ক্লান্ত’ হয়ে ‘আর চুপ না করে থাকার’ কথা বলেছেন। কবির আরও মনে আশা এই যে তাঁর এই সরব হওয়া ‘আরও অনেককেই মূক হয়ে থাকার হাত থেকে মুক্তি দেবে।’ গুন্টার গ্রাস কি তাহলে শুধুই ইসরায়েলের পরমাণু সামর্থ্যের বিরুদ্ধেই সোচ্চার? তা নয়। তিনি চান ‘ইসরায়েলের পরমাণু সামর্থ্য ও ইরানের পরমাণু স্থাপনা উভয়ের ওপরে আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত বাঁধাহীন ও স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ’। এতে করে ‘সকলে, ইসরায়েলিরা ও ফিলিস্তিনিরা’, এমনকি গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এমনকি ‘আমাদের সকলের’ তথা বিশ্ববাসীর মঙ্গল নিহিত বলে মনে করেন কবি।
গ্রাস কি ভুল বলেছেন কিছু? আসলে ভুল-শুদ্ধের প্রশ্ন নয়; জায়নবাদের বিপক্ষে যাওয়া বক্তব্যের জন্য গ্রাসের ওপরে আক্রমণ অবধারিত ছিল এবং তাই চলছে। গ্রাস ব্যাপারটি যে আগে থেকে বুঝতে পারেননি, তা মনে হয় না। মনে হয় যে গ্রাস বুঝেশুনেই কবিতার ছত্রচ্ছায়ায় জায়নবাদের সমালোচনার পথ বেছে নিয়েছেন। এতে কাজ হয়েছে। গ্রাসের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। বৃহস্পতিবার তিনি ‘যে কথা বলতেই হবে’ কবিতাটিকে ‘লজ্জাজনক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং দাবি করেন যে ইসরায়েল নয় বরং ইরান হচ্ছে ‘বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি’। গ্রাসের কবিতায় ইসরায়েলের হামলাতে ‘ইরানি জনগণের নিশ্চিহ্ন’ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। এটা মেনে নেননি নেতানিয়াহু। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের নিয়মিত আস্ফাালনের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এটা হচ্ছে ইরান, ইসরায়েল নয়, যে কি না অন্য রাষ্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার হুমকি দেয়।’ স্মর্তব্য, আহমাদিনেজাদ প্রায় প্রায়ই ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার হুমকি দিয়ে থাকেন। দেখা যাচ্ছে যে গ্রাসের কবিতার মধ্যে আহমাদিনেজাদকে খুঁজে বের করার একটা চেষ্টা হচ্ছে। শুক্রবার এক সাক্ষাৎকারে গুন্টার গ্রাস স্পষ্ট করেই বলেন যে তিনি ইসরায়েল নয় বরং নেতানিয়াহুর নীতিগুলোকে সমালোচনা করতে চেয়েছেন। কিন্তু এতে কাজ হচ্ছে না। নেতানিয়াহুদের পরিচালিত জায়নবাদের সমালোচনাকে ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান হিসেবে দেখানোর ব্যাপক চেষ্টা চলছে।
এখানেই শেষ নয়। গ্রাসকে নতুন করে ‘ইহুদি বিদ্বেষী’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টাও কবিতা প্রকাশিত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে জোরেশোরে শুরু হয়ে গেছে। ডানপন্থী-রক্ষণশীল বা জায়নবাদের সরাসরি সমর্থক মিডিয়ার কথা বাদ থাক, মধ্যপন্থী হিসেবে বিবেচিত বিলেতের গার্ডিয়ান, আমেরিকার নিউইয়র্ক টাইমস কিংবা ইসরায়েলের হারেৎজ-এর মতো পত্রিকায়ও ‘যে কথা বলতেই হবে’ নিয়ে প্রকাশিত নানামুখী লেখালেখিতে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে গুন্টার গ্রাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর জন্য কাজ করেছিলেন। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে এ ব্যাপারে নিজেই মুখ খোলেন গ্রাস এবং ১৭ বছর বয়সে নিজের মানসিক অবস্থান কেমন ছিল তা স্পষ্ট করেন। কিন্তু গ্রাসকে জায়নবাদীরা তখন থেকেই ‘ইহুদি বিদ্বেষী’ হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে। বলাই বাহুল্য, এবারের কবিতাটির জন্য গ্রাসের ওপরে তারা আরও অধিকমাত্রায় চড়াও হবে। কিন্তু তাতে কিছু এসে-যায় না। গ্রাসের লেখাটি এখন থেকে পশ্চিমের মূলধারার বিরুদ্ধে জোরালো একটি ভিন্নস্বর হিসেবে আলোচিত হতেই থাকবে।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
বুধবার জার্মানির স্যুডয়েচ জেইটাং পত্রিকায় ইসরায়েলি জায়নবাদের কঠোর সমালোচনাপূর্ণ ‘যে কথা বলতেই হবে’ শিরোনামের একটি কবিতা প্রকাশ করে বৃহস্পতিবার শুরুর আগেই জায়নবাদী ও জায়নবাদের সমর্থক-পৃষ্ঠপোষকদের বাক-আক্রমণের মধ্যে পড়ে গেলেন জার্মানির জীবিত লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান মুক্তবুদ্ধির লেখক গুন্টার গ্রাস (৮৪)।
গুন্টার গ্রাসের কি মতিভ্রম হয়েছে? জীবনসায়াহ্নে এসে নিজেকে এমন ঝামেলায় কেউ ফেলে? প্রধান শক্তিমান দেশ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে কী দেখা যায়? দেখা যায়, বড় দুই দলের বড় নেতারা কে কত বড় ইসরায়েল-বন্ধু সে প্রমাণে সারাক্ষণ হাস্যকরভাবে তৎপর। একজন যদি বলে যে ফিলিস্তিনিদের জেরুজালেমের ওপর থেকে দাবি তুলে নিতে হবে, আরেকজন তখন বলে ওঠে চলমান অশান্তির জন্য ফিলিস্তিনিদের গোঁয়ার্তুমিই দায়ী। পশ্চিমের মূলধারার মিডিয়াতে কী দেখা যায়? দেখা যায় যে ইরান একটা পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলতে যাচ্ছে এবং একবার যদি এই জিনিস ইরানের হাতে আসে, তাহলে আর দেখতে হবে না। কিন্তু ইসরায়েলের হাতে যে একই জিনিস অনেক দিন আগে থেকেই আছে, তা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য, আশঙ্কা পশ্চিমের মূলধারার মিডিয়াতে দেখা যায় না।
গ্রাসের নিজের দেশ জার্মানিতে কী দেখা যাচ্ছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনার ব্যাপারটি নিয়ে জার্মানরা অপরাধবোধে ভোগে। কিন্তু এই অপরাধবোধ কি ইসরায়েলের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম সাবমেরিন তুলে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত জার্মানি নিয়েছে, সে সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেয়? ‘অপরাধবোধটোধ’ কিছু নয়—আসল কথা হচ্ছে, বিশ্বমঞ্চে জায়নবাদের শক্তিমান উপস্থিতি, যা জার্মানি গ্রাহ্য করে। আর থাকে বাণিজ্য প্রসঙ্গ—ইসরায়েল হোক আর যে-ই হোক, পরমাণু অস্ত্রের হুমকি বাড়ুক কি না বাড়ুক, আসল কথা হচ্ছে অস্ত্র বেচে মুনাফা। এই যখন অবস্থা, তখন গ্রাসের কি এমন দরকার পড়ে গেল যে তিনি নিরুপদ্রব বা কল্পিত কোনো সমস্যা বা শত্রুকে বেছে না নিয়ে একেবারে জায়নবাদী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কবিতা লিখতে লেগে গেলেন?
গুন্টার গ্রাস আসলে সত্য-তাড়িত হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে নিজের মধ্যে চেপে রাখা কথাগুলো নির্ভীকে প্রকাশ করে দিয়ে মুক্ত হয়েছেন। নয়টি পঙিক্ততে বিভক্ত ৬৯ লাইন দীর্ঘ ‘যে কথা বলতেই হবে’ কবিতায় ইসরায়েলের জায়নবাদী নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন গ্রাস। ইরান একটি পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলছে এমত ধরে নিয়ে ইরানের ওপরে সামরিক হামলা চালানোর ইসরায়েলি আস্ফাালন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। গ্রাস কবিতায় লিখেননি কিন্তু আমরা জানি যে মৌলবাদী, উগ্র ডানপন্থী ও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সমর্থনপুষ্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কোয়ালিশন সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রাণভোমরাটিই হচ্ছে ফিলিস্তিন ও ইরানবিরোধী উগ্র আস্ফাালন। ধর্মগুরু শাসিত ইরানের মতো দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ইরানি পরমাণু স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করতে দেওয়া ও না-দেওয়া নিয়ে পশ্চিম ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে তেহরানের নিয়মিত বিতণ্ডার কথা আমরা জানি। কিন্তু আলোচ্য কবিতায় গ্রাস আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ইসরায়েলের পরমাণু স্থাপনা পরিদর্শনের ব্যাপারটি নিয়ে কখনো একটি কথাও হয় না।
তো, এত দিন পরে গ্রাসের কলমে কেন এসব কথা? ‘এত দিন কোথায় ছিলেন’ গ্রাস? ‘যে কথা বলতেই হবে’ কবিতাতে এ প্রশ্নটি নিজেকেই ছুড়ে দিয়েছেন গ্রাস। তাঁর ভাষায়, ‘এই বার্ধক্যে, দোয়াতের শেষ কালিটুকু দিয়ে’ কেন বলতে হচ্ছে ‘ইসরায়েলের পরমাণু সামর্থ্য ইতিমধ্যে ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া বিশ্বশান্তিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে’। ঠিক পরের লাইনেই উত্তর আছে, ‘কারণ এটা বলতেই হবে। এমনকি এটা বলার জন্য আগামীকালও হয়ে যেতে পারে ভীষণ বিলম্ব।’ ইসরায়েলকে পারমাণবিক অস্ত্রের সামর্থ্যসম্পন্ন নৌযান জোগানের মধ্য দিয়ে জার্মানির ‘একটি অপরাধের মদদদাতা’ হয়ে যাওয়ার ভয়ও গ্রাস করেছে গ্রাসকে। যুক্তির ক্ষেত্রে ভণ্ডামি পশ্চিমা শক্তিমানদের জন্য নতুন কিছু নয়। গুন্টার গ্রাস ‘পশ্চিমের ভণ্ডামিতে ক্লান্ত’ হয়ে ‘আর চুপ না করে থাকার’ কথা বলেছেন। কবির আরও মনে আশা এই যে তাঁর এই সরব হওয়া ‘আরও অনেককেই মূক হয়ে থাকার হাত থেকে মুক্তি দেবে।’ গুন্টার গ্রাস কি তাহলে শুধুই ইসরায়েলের পরমাণু সামর্থ্যের বিরুদ্ধেই সোচ্চার? তা নয়। তিনি চান ‘ইসরায়েলের পরমাণু সামর্থ্য ও ইরানের পরমাণু স্থাপনা উভয়ের ওপরে আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত বাঁধাহীন ও স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ’। এতে করে ‘সকলে, ইসরায়েলিরা ও ফিলিস্তিনিরা’, এমনকি গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এমনকি ‘আমাদের সকলের’ তথা বিশ্ববাসীর মঙ্গল নিহিত বলে মনে করেন কবি।
গ্রাস কি ভুল বলেছেন কিছু? আসলে ভুল-শুদ্ধের প্রশ্ন নয়; জায়নবাদের বিপক্ষে যাওয়া বক্তব্যের জন্য গ্রাসের ওপরে আক্রমণ অবধারিত ছিল এবং তাই চলছে। গ্রাস ব্যাপারটি যে আগে থেকে বুঝতে পারেননি, তা মনে হয় না। মনে হয় যে গ্রাস বুঝেশুনেই কবিতার ছত্রচ্ছায়ায় জায়নবাদের সমালোচনার পথ বেছে নিয়েছেন। এতে কাজ হয়েছে। গ্রাসের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। বৃহস্পতিবার তিনি ‘যে কথা বলতেই হবে’ কবিতাটিকে ‘লজ্জাজনক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং দাবি করেন যে ইসরায়েল নয় বরং ইরান হচ্ছে ‘বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি’। গ্রাসের কবিতায় ইসরায়েলের হামলাতে ‘ইরানি জনগণের নিশ্চিহ্ন’ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। এটা মেনে নেননি নেতানিয়াহু। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের নিয়মিত আস্ফাালনের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এটা হচ্ছে ইরান, ইসরায়েল নয়, যে কি না অন্য রাষ্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার হুমকি দেয়।’ স্মর্তব্য, আহমাদিনেজাদ প্রায় প্রায়ই ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার হুমকি দিয়ে থাকেন। দেখা যাচ্ছে যে গ্রাসের কবিতার মধ্যে আহমাদিনেজাদকে খুঁজে বের করার একটা চেষ্টা হচ্ছে। শুক্রবার এক সাক্ষাৎকারে গুন্টার গ্রাস স্পষ্ট করেই বলেন যে তিনি ইসরায়েল নয় বরং নেতানিয়াহুর নীতিগুলোকে সমালোচনা করতে চেয়েছেন। কিন্তু এতে কাজ হচ্ছে না। নেতানিয়াহুদের পরিচালিত জায়নবাদের সমালোচনাকে ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান হিসেবে দেখানোর ব্যাপক চেষ্টা চলছে।
এখানেই শেষ নয়। গ্রাসকে নতুন করে ‘ইহুদি বিদ্বেষী’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টাও কবিতা প্রকাশিত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে জোরেশোরে শুরু হয়ে গেছে। ডানপন্থী-রক্ষণশীল বা জায়নবাদের সরাসরি সমর্থক মিডিয়ার কথা বাদ থাক, মধ্যপন্থী হিসেবে বিবেচিত বিলেতের গার্ডিয়ান, আমেরিকার নিউইয়র্ক টাইমস কিংবা ইসরায়েলের হারেৎজ-এর মতো পত্রিকায়ও ‘যে কথা বলতেই হবে’ নিয়ে প্রকাশিত নানামুখী লেখালেখিতে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে গুন্টার গ্রাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর জন্য কাজ করেছিলেন। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে এ ব্যাপারে নিজেই মুখ খোলেন গ্রাস এবং ১৭ বছর বয়সে নিজের মানসিক অবস্থান কেমন ছিল তা স্পষ্ট করেন। কিন্তু গ্রাসকে জায়নবাদীরা তখন থেকেই ‘ইহুদি বিদ্বেষী’ হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে। বলাই বাহুল্য, এবারের কবিতাটির জন্য গ্রাসের ওপরে তারা আরও অধিকমাত্রায় চড়াও হবে। কিন্তু তাতে কিছু এসে-যায় না। গ্রাসের লেখাটি এখন থেকে পশ্চিমের মূলধারার বিরুদ্ধে জোরালো একটি ভিন্নস্বর হিসেবে আলোচিত হতেই থাকবে।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন