এত দিন কোনো মুখোমুখি পরীক্ষা সে অর্থে হয়নি। কিন্তু এবার যখন ক্ষমতাসীনেরা সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনল, তখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেল, সামরিক আমল থেকে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধীদের প্রচার-প্রচারণা অত্যন্ত ফলবান হয়েছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধীদের ভয়ে এবার ক্ষমতাসীনেরা এমন এক ধর্মনিরপেক্ষতা উপহার দিলেন, যা পৃথিবীতে কেউ কখনো দেখেনি, কেউ কখনো শোনেওনি। একটি রাষ্ট্রধর্ম থাকবে, একটি নির্দিষ্ট ধর্মের বাণী উদ্ধৃত থাকবে এবং একই সঙ্গে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকবে—এর কোনো মানে হয় না। এটা কোথাও নেই। আমাদের দেশের বাস্তবতার দোহাই এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো মুশকিল। কারণ, কেউ যদি নিজেকে উদারনৈতিক গণতন্ত্রপ্রেমী মনে করেন, তাহলে নির্দিষ্ট বিরতিতে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিশ্বাস করাটা তাঁর জন্য প্রাথমিক শর্ত। ঠিক একইভাবে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করলে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো ধর্মকে প্রাধান্য না দেওয়াটাই হচ্ছে প্রাথমিক শর্ত। ধর্মনিরপেক্ষতা না চাইলে নেই, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা চাইলে এই প্রাথমিক শর্তটুকু পূরণ করাটা একান্ত আবশ্যক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রাথমিক শর্ত অগ্রাহ্য করেই বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রবিষ্ট হলো।
নিরন্তর প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার বিশাল বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন বাংলাদেশের মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িকতাবাদী ও নব্য রক্ষণশীলেরা। ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধী প্রচারণায় মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক লাইনের লোকেদের কায়দাটি সোজাসাপটা। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাকে তাঁরা ধর্মহীনতা তথা নাস্তিকতা হিসেবে বর্ণনা করে ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। আর ধর্মনিরপেক্ষতা-সংক্রান্ত আলোচনাটি যে মূলত রাষ্ট্র-পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের অনুপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা-সংক্রান্ত, তা বেশির ভাগ সময় এড়িয়ে যান অথবা উল্লেখ করলেও নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা-বয়ান হাজির করেন। অন্যদিকে, নব্য রক্ষণশীলদের দাবি হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা পশ্চিমা আধুনিকতা-উদ্ভূত একটি ধারণা, যা আমাদের এখানে কাজ করে না। আশ্চর্যের বিষয় এই যে পশ্চিমা ধাঁচের রাষ্ট্রব্যবস্থা, পশ্চিম থেকে আসা বুর্জোয়া গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র বা পশ্চিমা সংস্কৃতির বিষয়ে এদের হঠাৎ হঠাৎ বিরোধিতা থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে ক্রোধের মাত্রাটি সর্বাধিক।
দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধিতার কুফল এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতেও ভয় বা জড়তায় ভোগেন। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে যেকোনো বার্তাকেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে চিত্রিত করার ক্ষেত্রে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছেন ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধীরা। এ ক্ষেত্রে পঁচাত্তরের পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধীদের রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তাপ্রাপ্তির বিষয়টি মাথায় রেখেও রাষ্ট্রকর্মে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজনসংক্রান্ত মূল কথাগুলো ধর্মপ্রাণ জনসাধারণের সামনে হাজির করার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাপন্থী সামাজিক শক্তিগুলোর দুর্বলতার বা ব্যর্থতার প্রসঙ্গটি স্মরণে রাখতেই হবে। এখন হঠাৎ করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করে বা দলটির ওপর অভিমান করে তেমন ফায়দা হবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক দলের মূল হিসাব থাকে ভোটের ব্যাপারে। আওয়ামী লীগ সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা আবার ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভোট-ব্যাংকের দিকে খেয়াল রাখছে—এতে আর বিচিত্র কী!
লক্ষ করার ব্যাপার হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গটি সামনে এলে পক্ষ ও বিপক্ষ উভয়ই এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে সামনে রেখে অস্বাভাবিক স্পর্শকাতর এক পরিস্থিতির অবতারণা করে। যেন এ দেশ ছাড়া আর কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে কস্মিনকালেও ধর্মনিরপেক্ষতা চালু হওয়া দূরে থাকুক, এ নিয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। আসলে বাস্তব পরিস্থিতি কী? বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, ২০০৯ সালের এক হিসাবমতে ১৩টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির উল্লেখ ও ব্যাখ্যা আছে। দেশগুলো হচ্ছে: আজারবাইজান, বারকিনো ফাসো, চাদ, গায়না, কাজাখস্তান, কসোভো, কিরগিজস্তান, মালি, নাইজার, সেনেগাল, তাজাকিস্তান, তুরস্ক ও তুর্কমেনিস্তান। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশগুলোর কোনোটিই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের অজুহাত তুলে কোনো রাষ্ট্রধর্মের বিধান রাখেনি বা সংবিধানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মগ্রন্থ থেকে বাণী নিয়ে তা সংবিধানে যুক্ত করেনি। এসব দেশ ছাড়াও আরও ছয়টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ আছে, যেগুলোতে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রাধান্য পাওয়া কোনো ধর্ম নেই এবং যাদের লিগ্যাল সিস্টেম মোটের ওপর ধর্মনিরপেক্ষ। দেশগুলো হচ্ছে: আলবেনিয়া, গাম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লেবানন, সিয়েরা লিওন, সিরিয়া ও উজবেকিস্তান। দেখা যাচ্ছে, আরব অঞ্চল ছাড়া অন্য অঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতা স্বভাবজাত।
উল্লিখিত দেশগুলোর কয়েকটি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়ে রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, চাদের সংবিধানের ৩৫ নম্বর ধারায় রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিঘ্নিত করে এমন যেকোনো কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ মাত্রার রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। গায়না (ধারা ৯১) ও তাজিকিস্তানের (ধারা ১০০) মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের সংবিধান মোতাবেক ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ রিভিশনের বিষয় হতে পারে না। মালিতে (ধারা ২৫) ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ওপর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। নাইজারে (ধারা ৮ ও ৯) কোনো ধর্ম রাজনৈতিক ক্ষমতার দাবিদার হতে পারে না; এ ছাড়া দেশটিতে ধর্মীয় ভাবযুক্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। তাজিকিস্তানের (ধারা ৮ ও ২৬) সংবিধান রাষ্ট্রধর্মের বিধান নিষিদ্ধ করেছে; আর কোনো ব্যক্তি চাইলে দেশটিতে বিনা বাধায় ধর্মহীন জীবন যাপন করতে পারে। এসব ছাড়াও উল্লিখিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৯টি দেশের সংবিধানেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষা, আইন বা রাজনীতির ক্ষেত্রে নানা ধরনের সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা যুক্ত করা আছে।
স্বাভাবিক যে এসব দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা চ্যালেঞ্জবিহীন অবস্থায় নেই। চ্যালেঞ্জ থাকাটাই স্বাভাবিক। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ এসব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সাংবিধানিকভাবে টিকে আছে। এতগুলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সম্ভব হলে বাংলাদেশের সমস্যাটা কোথায়? সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতাধারী দল ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যা করল, তাতে ধর্মনিরপেক্ষতার সংগ্রাম জোরদার হওয়া দূরে থাকুক, সামনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনেরা কোনো ফায়দা ওঠাতে পারবে বলেও মনে হয় না।
আসলে সামাজিক পর্যায়ে ব্যাপক আবেদন তৈরি করার কষ্টকর সংগ্রামের স্তর পার না হয়ে আদালত ও সংসদের ওপর ভর করে আর যা-ই হোক, টেকসই সাধারণভাবে গ্রাহ্য ধর্মনিরপেক্ষতার আশা করা অবান্তর। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবারের সংবিধান সংশোধনীতে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত না করলে ক্ষতি ছিল না। আরেকটা কথা হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধীরা ক্ষমতায় এলে টুটোফাটা এই ধর্মনিরপেক্ষতাটুকু রাখবে না এবং এই কর্ম করে তারা পার পেয়ে যাবে, যা উদাহরণস্বরূপ তুরস্কের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে সম্ভব নয়। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, গত তিন মেয়াদ দেশটিতে ধর্মবাদীরা ক্ষমতায়, কিন্তু প্রতি পদে তাদের বলতে হয় যে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে। এই হচ্ছে সমাজ দেহে কোনো একটি মতাদর্শকে প্রোথিত করতে পারার সুবিধা। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, তুর্কিরা অসম্ভব ধর্মপ্রাণ, কিন্তু তাদের অধিকাংশই রাষ্ট্রকর্মে ধর্মের উপস্থিতি চায় না। বাংলাদেশের জন্যও তো এটুকুই চাওয়া। কিন্তু তেমন কিছু হতে হলে শুধু রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা হবে না। ধর্মনিরপেক্ষতাপন্থী সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লম্বা সময় সামাজিক পরিসরে কাজ করতে হবে। তখন আর ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিকে গোঁজামিলের আশ্রয় নিতে হবে না; যেমনটি করা হয়েছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে।
শান্তনু মজুমদার: শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ধর্মনিরপেক্ষতা-বিষয়ক গবেষক।
নিরন্তর প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার বিশাল বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন বাংলাদেশের মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িকতাবাদী ও নব্য রক্ষণশীলেরা। ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধী প্রচারণায় মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক লাইনের লোকেদের কায়দাটি সোজাসাপটা। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাকে তাঁরা ধর্মহীনতা তথা নাস্তিকতা হিসেবে বর্ণনা করে ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। আর ধর্মনিরপেক্ষতা-সংক্রান্ত আলোচনাটি যে মূলত রাষ্ট্র-পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের অনুপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা-সংক্রান্ত, তা বেশির ভাগ সময় এড়িয়ে যান অথবা উল্লেখ করলেও নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা-বয়ান হাজির করেন। অন্যদিকে, নব্য রক্ষণশীলদের দাবি হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা পশ্চিমা আধুনিকতা-উদ্ভূত একটি ধারণা, যা আমাদের এখানে কাজ করে না। আশ্চর্যের বিষয় এই যে পশ্চিমা ধাঁচের রাষ্ট্রব্যবস্থা, পশ্চিম থেকে আসা বুর্জোয়া গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র বা পশ্চিমা সংস্কৃতির বিষয়ে এদের হঠাৎ হঠাৎ বিরোধিতা থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে ক্রোধের মাত্রাটি সর্বাধিক।
দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধিতার কুফল এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতেও ভয় বা জড়তায় ভোগেন। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে যেকোনো বার্তাকেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে চিত্রিত করার ক্ষেত্রে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছেন ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধীরা। এ ক্ষেত্রে পঁচাত্তরের পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধীদের রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তাপ্রাপ্তির বিষয়টি মাথায় রেখেও রাষ্ট্রকর্মে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজনসংক্রান্ত মূল কথাগুলো ধর্মপ্রাণ জনসাধারণের সামনে হাজির করার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাপন্থী সামাজিক শক্তিগুলোর দুর্বলতার বা ব্যর্থতার প্রসঙ্গটি স্মরণে রাখতেই হবে। এখন হঠাৎ করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করে বা দলটির ওপর অভিমান করে তেমন ফায়দা হবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক দলের মূল হিসাব থাকে ভোটের ব্যাপারে। আওয়ামী লীগ সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা আবার ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভোট-ব্যাংকের দিকে খেয়াল রাখছে—এতে আর বিচিত্র কী!
লক্ষ করার ব্যাপার হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গটি সামনে এলে পক্ষ ও বিপক্ষ উভয়ই এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে সামনে রেখে অস্বাভাবিক স্পর্শকাতর এক পরিস্থিতির অবতারণা করে। যেন এ দেশ ছাড়া আর কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে কস্মিনকালেও ধর্মনিরপেক্ষতা চালু হওয়া দূরে থাকুক, এ নিয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। আসলে বাস্তব পরিস্থিতি কী? বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, ২০০৯ সালের এক হিসাবমতে ১৩টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির উল্লেখ ও ব্যাখ্যা আছে। দেশগুলো হচ্ছে: আজারবাইজান, বারকিনো ফাসো, চাদ, গায়না, কাজাখস্তান, কসোভো, কিরগিজস্তান, মালি, নাইজার, সেনেগাল, তাজাকিস্তান, তুরস্ক ও তুর্কমেনিস্তান। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশগুলোর কোনোটিই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের অজুহাত তুলে কোনো রাষ্ট্রধর্মের বিধান রাখেনি বা সংবিধানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মগ্রন্থ থেকে বাণী নিয়ে তা সংবিধানে যুক্ত করেনি। এসব দেশ ছাড়াও আরও ছয়টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ আছে, যেগুলোতে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রাধান্য পাওয়া কোনো ধর্ম নেই এবং যাদের লিগ্যাল সিস্টেম মোটের ওপর ধর্মনিরপেক্ষ। দেশগুলো হচ্ছে: আলবেনিয়া, গাম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লেবানন, সিয়েরা লিওন, সিরিয়া ও উজবেকিস্তান। দেখা যাচ্ছে, আরব অঞ্চল ছাড়া অন্য অঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতা স্বভাবজাত।
উল্লিখিত দেশগুলোর কয়েকটি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়ে রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, চাদের সংবিধানের ৩৫ নম্বর ধারায় রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিঘ্নিত করে এমন যেকোনো কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ মাত্রার রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। গায়না (ধারা ৯১) ও তাজিকিস্তানের (ধারা ১০০) মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের সংবিধান মোতাবেক ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ রিভিশনের বিষয় হতে পারে না। মালিতে (ধারা ২৫) ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ওপর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। নাইজারে (ধারা ৮ ও ৯) কোনো ধর্ম রাজনৈতিক ক্ষমতার দাবিদার হতে পারে না; এ ছাড়া দেশটিতে ধর্মীয় ভাবযুক্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। তাজিকিস্তানের (ধারা ৮ ও ২৬) সংবিধান রাষ্ট্রধর্মের বিধান নিষিদ্ধ করেছে; আর কোনো ব্যক্তি চাইলে দেশটিতে বিনা বাধায় ধর্মহীন জীবন যাপন করতে পারে। এসব ছাড়াও উল্লিখিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৯টি দেশের সংবিধানেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষা, আইন বা রাজনীতির ক্ষেত্রে নানা ধরনের সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা যুক্ত করা আছে।
স্বাভাবিক যে এসব দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা চ্যালেঞ্জবিহীন অবস্থায় নেই। চ্যালেঞ্জ থাকাটাই স্বাভাবিক। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ এসব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সাংবিধানিকভাবে টিকে আছে। এতগুলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সম্ভব হলে বাংলাদেশের সমস্যাটা কোথায়? সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতাধারী দল ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যা করল, তাতে ধর্মনিরপেক্ষতার সংগ্রাম জোরদার হওয়া দূরে থাকুক, সামনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনেরা কোনো ফায়দা ওঠাতে পারবে বলেও মনে হয় না।
আসলে সামাজিক পর্যায়ে ব্যাপক আবেদন তৈরি করার কষ্টকর সংগ্রামের স্তর পার না হয়ে আদালত ও সংসদের ওপর ভর করে আর যা-ই হোক, টেকসই সাধারণভাবে গ্রাহ্য ধর্মনিরপেক্ষতার আশা করা অবান্তর। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবারের সংবিধান সংশোধনীতে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত না করলে ক্ষতি ছিল না। আরেকটা কথা হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধীরা ক্ষমতায় এলে টুটোফাটা এই ধর্মনিরপেক্ষতাটুকু রাখবে না এবং এই কর্ম করে তারা পার পেয়ে যাবে, যা উদাহরণস্বরূপ তুরস্কের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে সম্ভব নয়। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, গত তিন মেয়াদ দেশটিতে ধর্মবাদীরা ক্ষমতায়, কিন্তু প্রতি পদে তাদের বলতে হয় যে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে। এই হচ্ছে সমাজ দেহে কোনো একটি মতাদর্শকে প্রোথিত করতে পারার সুবিধা। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, তুর্কিরা অসম্ভব ধর্মপ্রাণ, কিন্তু তাদের অধিকাংশই রাষ্ট্রকর্মে ধর্মের উপস্থিতি চায় না। বাংলাদেশের জন্যও তো এটুকুই চাওয়া। কিন্তু তেমন কিছু হতে হলে শুধু রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা হবে না। ধর্মনিরপেক্ষতাপন্থী সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লম্বা সময় সামাজিক পরিসরে কাজ করতে হবে। তখন আর ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিকে গোঁজামিলের আশ্রয় নিতে হবে না; যেমনটি করা হয়েছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে।
শান্তনু মজুমদার: শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ধর্মনিরপেক্ষতা-বিষয়ক গবেষক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন