রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১২

ফ্রান্সে ডানপন্থীদের মহা উত্থান!


ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুখোমুখি সারকোজি ও ওলাঁদ
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুখোমুখি সারকোজি ও ওলাঁদ

‘স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ’কে আপ্তবাক্য হিসেবে গ্রহণকারী দেশ ফ্রান্সে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফার ভোটে কট্টর ডানপন্থীরা আশাতীত সাফল্য লাভ করেছে। এটা দীর্ঘদিনের ব্যবধানে একজন সমাজতন্ত্রীর ক্ষমতায় আসীন হওয়ার সম্ভাবনাবিষয়ক আলাপ-আলোচনাকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। প্রথম দফার ভোটে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও রক্ষণশীল ইউএমপির প্রার্থী নিকোলা সারকোজির তুলনায় এগিয়ে থেকেছেন পার্টি সোশ্যালিয়েস্তার ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ। প্রথমজন প্রদত্ত ভোটের ২৭ ভাগের সামান্য বেশি এবং দ্বিতীয় জন ২৮ ভাগের কিছু বেশি ভোট পেয়েছেন। ১৯৫৮ সালে ফিফথ রিপাবলিকের সূচনার পর থেকে প্রথম দফার ভোটে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের হেরে যাওয়া এই প্রথম কিন্তু এসব এখন দ্বিতীয় আলোচ্য। ১৮ ভাগের বেশি ভোট পেয়ে ফ্রন্ট ন্যাশনাল দলের মারি লে পেনের তৃতীয় স্থান লাভ করাটাই হচ্ছে এ মুহূর্তে ফ্রান্সসহ গোটা ইউরোপের প্রধান আলোচনা। ইউরোপের দেশে দেশে উদারনীতিকদের মধ্যে পেনের উত্থানকে বড় এক আশঙ্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এমনকি, সারকোজির সমর্থক জার্মানির রক্ষণশীল চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল পর্যন্ত পেনের উত্থানকে ‘ত্রাসজনক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। 
এটা এখন স্পষ্ট যে ন্যাশনাল সমর্থকদের মতিগতির ওপরই আগামী ৬ মে অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় দফার ভোটের ফলাফল অনেকাংশে নির্ভর করবে। সাদা চোখে মনে হতে পারে, একটা দল প্রথম দফার ভোটে তৃতীয় হয়েছে এবং দ্বিতীয় দফার ওপরে তাদের সমর্থনের প্রভাব থাকছে, তাতে কী হয়েছে? আসলে অনেক কিছুই হয়ে গেছে। বলতে কি ‘একটা ভূত’ এখন ইউরোপের উদারনীতিকদের তাড়া করছে, উগ্র ডানপন্থার ভূত। এই ভূত ভিন্ন জাতি, ভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষ, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন সংস্কৃতিবিদ্বেষী এবং এই ভূতের সমর্থন বাড়ছে শ্রমজীবী শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে। ফ্রন্ট ন্যাশনালে এই ভূতের ফরাসি সংস্করণ বলা চলে। পেনের দল অভিবাসন ও অভিবাসীদের চরম বিরোধী, অভিবাসন ঠেকানোর জন্য সীমান্তে কঠোরতম নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার দাবিদার। ফরাসিদের জীবনমান নেমে যাওয়ার পেছনে অভিবাসীদেরই এরা দায়ী করতে চায়; আর মনে করে যে সারকোজি নিজে একজন রক্ষণশীল হয়েও সাবেক উপনিবেশসহ গরিব দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসনের স্রোত ঠেকানো তো দূরের কথা, যারা ঢুকে পড়ার পরে ধরা পড়েছে, তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছেন। ফ্রন্ট ন্যাশনালের বক্তব্য হচ্ছে, অভিবাসীদের হাত থেকে বাঁচার প্রয়োজনে ফ্রান্সকে ২২টি ইউরোপীয় ও তিনটি অ-ইউরোপীয় দেশের সমন্বয়ে গঠিত শেনজেন এলাকা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। উল্লেখ্য, শেনজেনভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণের জন্য যেসব দেশের নাগরিকদের ভিসা প্রয়োজন হয়, তারা যেকোনো একটি দেশের ভিসা সংগ্রহ করলেই চলে। ফ্রন্ট ন্যাশনালে ‘দ্বৈত নাগরিকত্ব’ ব্যবস্থারও বিরোধী। তাদের কথা হচ্ছে, যে লোকগুলো ফ্রান্সের নাগরিকত্ব পাওয়ার পরও ছেড়ে আসা দেশের নাগরিকত্ব রেখে দেয় তারা আসলে ফ্রান্সের প্রতি কখনোই প্রকৃত অর্থে নিবেদিতপ্রাণ হয় না। এদের কথা হচ্ছে ‘ন্যাশনালিটি’ জন্মগত বিষয়, অতএব ‘ন্যাচারালাইজেশন’ করার মধ্য দিয়ে বিদেশিদের ‘নাগরিকত্ব’ দেওয়ার ব্যাপারটিকে ধরতে হবে ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে। 
মোট কথা, পেনরা ফ্রান্সকে ভয়তাড়িত একটি সমাজে পরিণত করে রাজনৈতিক কৌশল হাসিল করতে চাইছেন। এটা বিশ্বব্যাপী নরম, গরম ও ছদ্মবেশী ডানপন্থীদের পুরোনো কৌশল। এই কৌশলের অংশ হিসেবে অবিরাম প্রচার করতে থাকা হয় যে মূলধারা তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি বা ধর্মের লোকেরা সংখ্যালঘুদের (দেশভেদে এটা হতে পারে ধর্মীয়, জাতিগত বা অভিবাসী) কারণেই দুর্গতির শিকার হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। হাতের কাছে বর্তমানের কোনো উদাহরণ না থাকলে অতীত খুঁড়ে কোনো একটা নজির বের করে সংখ্যাগুরুদের তাতানো হয়; একই সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে আরও খারাপ অবস্থা হবে বলেও ভীতি ছড়ানো হয়। ফ্রান্সের মতো দেশগুলোতে অভিবাসীদের কারণেই আবহমান ‘ফরাসি জীবনযাত্রা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার’ বিলাপ করা হয়। 
সাধারণ পরিস্থিতিতে হয়তো এসবে তেমন কিছু এসে যায় না; কেননা, ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলো গরিব দেশের এলিট বুদ্ধিজীবীদের যুক্তির বহর ও দাবি-দাওয়া ছাড়াই সস্তা শ্রমের সুযোগ নেওয়া এবং কায়িক পরিশ্রমের কাজগুলো করানোর জন্য গরিব দেশগুলো থেকে দক্ষ ও কম দক্ষ লোকজন নিতে বাধ্য। সুতরাং কিছু উগ্র জাতীয়তাবাদী বা ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের আস্ফাালনে উদারনীতিকেরা তেমন গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু এখন সময়টা খারাপ। অর্থনৈতিক মন্দার বছরগুলোতে ফ্রান্সের শ্রমজীবীদের অবস্থা সত্যি খারাপ। কাজ নেই হয়ে যাচ্ছে, কাজ কমে যাচ্ছে, কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যার পরিণতিতে মৌলিক চাহিদা পূরণে সমস্যা না হলেও জীবন উপভোগের নিত্য-উপচারগুলোতে টান পড়ে যাচ্ছে সাংঘাতিক। এমন একটা অবস্থারই সুযোগ নিচ্ছে উগ্র ডানরা। তারা ফরাসি শ্রমজীবীদের বলছে, অভিবাসীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা করতে গিয়েই সরকার তাদের জন্য কিছু করতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং সামনে এই ব্যর্থতা আরও প্রকট হবে। শ্রমজীবীদের মধ্যে মিথ্যা করে একটি ‘নিপীড়িতের’ বোধ প্রকট করা হচ্ছে এবং এই ‘নিপীড়িত’ হওয়ার পেছনে মূলত ‘শিথিল অভিবাসন’ব্যবস্থা দায়ী বলেই অনেক দিন থেকেই প্রচারণা চালাচ্ছে পেনরা। 
প্রথম দফার ভোটের ফল বলছে, পেনদের কৌশল কাজ দিচ্ছে। মূলত অভাবী দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসীদের দিকে শ্রমজীবী ফরাসিদের তারা ভালোভাবেই লেলিয়ে দিতে পেরেছে। ফ্রন্ট ন্যাশনালে মোট ভোট পেয়েছে সাড়ে ছয় মিলিয়নের মতো। এর মধ্যে বেশির ভাগ ভোট যাদের কাছ থেকে এসেছে তারা হচ্ছে দরিদ্র, অস্থায়ী শ্রমিক, আয়-রোজগারের সুযোগ কম এমন গ্রামাঞ্চল ও শহরের উপকণ্ঠে বাসকারী, সাবেক শিল্পাঞ্চলের বাসিন্দা। এসব ভোটার প্রথাগতভাবে বামপন্থীদের ভোট দেয়; এবার ঘটেছে ব্যতিক্রম। নতুন ভোটারদের কাছ থেকেও ভালো সাড়া পেয়েছে পেনের দল। তার মানে হচ্ছে নবীন প্রজন্মের একটি অংশও যাবতীয় দুর্গতির জন্য অভিবাসীদেরই দায়ী করার শিক্ষা নিচ্ছে। 
জনমত জরিপগুলোতে এবার ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদকেই জয়ী দেখা যাচ্ছিল। প্রথম দফাতে তার প্রতিফলন ঘটলেও দ্বিতীয় দফায় জান বাজি রাখবেন সারকোজি। তিনি পেনের ভোটগুলো নিজের দিকে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তিনি বলতে শুরু করে দিয়েছেন যে ফ্রন্ট ন্যাশনালের কথা শুনতেই হবে। তবে সারকোজি সম্ভবত পেনের ভোটারদের সব ভোট পাবেন না। কেননা, রক্ষণশীল সারকোজিকে এরা যথেষ্ট মাত্রার ডানপন্থী মনে করে না। আর পেনও সম্ভবত সারকোজিকে জেতাতে চাইবেন না। মে মাসের প্রথম দিন পেন ভাষণ দেবেন; তখন সব স্পষ্ট হবে। তবে সমাজতন্ত্রী ওলাঁদ জিতলেও পেনের লাভ। সারকোজির রাজনৈতিক কবরের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি তখন ফরাসি ডানপন্থার একচ্ছত্র নেতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ পাবেন। একই সঙ্গে উদারনীতিক ও বামপন্থীরা অভিবাসীদের বেশি সুযোগ দেয়, এই কথা বিরামহীন বলে-বলে গড় ফরাসিদের মন আরও বিষিয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবেন, যা তাকে ভবিষ্যতের নির্বাচনে ফায়দা দেবে। ন্যাশনাল ফ্রন্টের কথা বাদ দিলেও ওলাঁদের জেতার ভালো সম্ভাবনা আছে। প্রথম দফাতে লেফট পার্টির জাঁ লুক মেলেঁশো ১১ ভাগ ভোট পেয়েছেন; এঁরা সারকোজির পুনর্নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার ভয়ে ওলাঁদকে ভোট দিতে পারে। আরও আছে রাজনীতিতে উদাসীন ও রাজনীতিতে বিতৃষ্ণ মুক্তমনা-উদারমনস্ক লোকজন; এরা সারকোজিকে ঠেকাতে আলস্য-উদাসীনতা ত্যাগ করে ভোট দিতে আসতে পারে। এসব বিবেচনায় নিলে সারকোজি শেষ। কিন্তু পেনদের হাত থেকে বাঁচতে পারবেন না ওলাঁদ। কেননা, অর্থনৈতিক কোনো জাদু তিনি ক্ষমতাতে এসেই দেখাতে পারবেন না; অতএব শ্রমজীবী ফরাসিদের মন-দিলও শান্ত হয়ে উঠবে না। ফলে পেনদের জন্য পড়ে থাকবে ‘ভিকটিমহুড’ প্রচারের উর্বর ক্ষেত্র। পেন বলেছেন, ‘ফ্রাস আর আগের মতো থাকবে না।’ মন্দার টান না কমলে মনে হচ্ছে পেনের আস্ফাালনই সত্য হয়ে যাবে; বিশ্বের চোখে চেনা ফ্রান্স অনেকটাই বদলে যাবে। 
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক।

রবিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১২

মোবারক থেকে মিলিটারি

আচমকা তেড়েফুঁড়ে ওঠা জনতার তোপে কোনো এক শাসকের পতন সত্যিকার অর্থে কতটুকু মানে তৈরি করে? গত কয়েক দিনে মিসরের ঘটনাপ্রবাহ অবধারিতভাবেই এ প্রশ্নের সামনে টেনে দাঁড় করায় আমাদের। ক্ষমতা কেমন করে বলতে গেলে আপসে স্বৈরাচারের হাত থেকে সেনার কোলে উঠে পড়তে পারে, তা কয়েক দিন আগে প্রত্যক্ষ করা গেল মিসরে। মোবারক থেকে মিলিটারির হাতে পড়া মিসরের ঘটনাপ্রবাহ এই বার্তা দেয়, সুচিন্তিত সাংগঠনিক প্রস্তুতি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও প্রশিক্ষণসম্পন্ন নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে হাজারও ন্যায্য কারণে ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ-রুষ্ট বিপুলসংখ্যক মানুষ মহা ভূমিকম্পের মতো গর্জে উঠে দ্রুতই দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে দিতে পারলেও তাদের অর্জন বেহাত হয়ে যেতে পারে ততধিক দ্রুততায়। 
মিসরের ঘটনার প্রভাব আরব বিশ্বে কেমন হবে, তা সময় বলে দেবে। তবে এটা স্পষ্ট যে মিসরে দেড় পক্ষব্যাপী পলিটিক্যাল মেলোড্রামার আপাত-অবসান হয়েছে মিলিটারির হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। গত শুক্রবার মোবারকি শাসন অবসানের ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে দেশটিতে মিলিটারি শাসনের প্রাথমিক বিকারগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করে। অবশ্য এতে আশ্চর্য হওয়ার অবকাশ নেই একেবারেই। মোবারকের গদি ছাড়ার কয়েক দিন আগে থেকে জনতা আর অপজিশন-এলিটদের মিলিটারি-বন্দনা প্রকাশ্য রূপ নেয়। ‘গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের’ পথে সুদৃঢ় ভূমিকা নেওয়ার জন্য মিসরীয় মিলিটারির প্রতি বারাক ওবামার উদাত্ত আহ্বান জানানোর রাজনীতি বোঝা তেমন কঠিন নয়—একসময় আফগানিস্তানে মার্ক্সবাদ ঠেকাতে মৌলবাদ কাজে লেগেছিল; মিসরে মৌলবাদ ঠেকাতে মিলিটারি থেরাপি ভাবা হচ্ছে বলে মনে করা হয়। আচমকা দৃশ্যপটে উদিত এলবারাদি মোবারকের গড়িমসিতে দৃশ্যত ত্যক্ত হয়ে প্রকাশ্যে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে দু-একটি কড়া উক্তি করলেও মিলিটারিকে তিনিও স্বাগত জানান। এখন অবশ্য মিলিটারি ‘যোগ্য’ প্রতিদান দিচ্ছে। কমান্ডাররা জানাচ্ছেন, সামনের দিনগুলোতে তাঁরা দৃশ্যপটে বারাদিকে চাইছেন না। মিলিটারি সম্ভবত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাতে চাইবে যে বারাদিকে টেবিলে না রেখেও অগ্রসর হওয়া যায়। এতে করে পরিস্থিতির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণের একটা প্রমাণ দেখানো যাবে। এ ছাড়া মুরব্বিদের সামনে নিজেদের প্রয়োজনীয়তা অধিক কার্যকরভাবে বাজারজাত করা যাবে। আরও লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, বারাদিকে আলোচনার টেবিলে ডাকা না হলেও নিষিদ্ধ মুসলিম ব্রাদারহুডের লোকজনের সঙ্গে কমান্ডারদের বৈঠক ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। ব্রাদারহুডের বৈঠকে যাওয়াটাও নব্য-ক্ষমতাধারীদের জন্য প্লাস পয়েন্ট। এর মাধ্যমে প্রভু রাষ্ট্রকে এই মর্মে প্রমাণ করা যাবে যে মিলিটারি ব্রাদারহুডিদের সঙ্গে সমঝে চলায় সক্ষম। 
বারাদি নাহয় বাইরের শক্তির সমীকরণের অন্তর্ভুক্ত এক ঘুঁটি। কিন্তু ১৮ দিনের আন্দোলনকালে মিসরীয়দের মধ্যে মিলিটারিপ্রীতির যে নমুনা দেখা গেছে, তার ব্যাখ্যা কী? মনে কি পড়ে না কায়রোর রাস্তায় কামানের গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে পলিটিক্যালি অশুদ্ধ নৃত্য ও উল্লাসের ঘটনা? এই তো গত সপ্তাহের ঘটনা। মিলিটারির ক্ষমতা কুক্ষীকরণ-প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার কিছু কণ্ঠ এখনো শোনা যাচ্ছে। তবে এদের জন্য পত্রিকার পাতায় লাইন আর টিভি রিপোর্টিংয়ে সময় বরাদ্দ—দুটোই কমে যাচ্ছে। কেননা বাস্তবতা এই যে, অর্জিত বিজয় সংহত হওয়ার আগেই জনতা রাজপথ থেকে ঘরে ফিরে গেছে। স্বল্পসংখ্যক ভিন্ন স্বরের জন্য মিডিয়া সার্বক্ষণিকভাবে ব্যতিব্যস্ত থাকবে, তা আশা করা যায় না। মোবারক হটানো মিসরীয়দের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলা যায়, আন্দোলনে অর্জিত ‘লাভের গুড়’ এখন ‘পিঁপড়ায়’ খেতে শুরু করেছে।
মিসরের সর্বশেষ পরিস্থিতির আরও একটি লক্ষণীয় দিক হলো, ক্ষমতা হাতে পাওয়া মাত্রই মোবারকবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ভেদ তৈরিতে সচেষ্ট হয়েছে মিলিটারি। বিশেষ করে সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় কাদের ডাকা হচ্ছে না বা হচ্ছে, তা নিয়ে মোবারকবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া নানা ছোট-বড় গ্রুপের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস দানা বেঁধে উঠতে শুরু করেছে বলে ধারণা দিয়েছে কোনো কোনো মিডিয়া। 
আরেকটি ব্যাপার ভুলে গেলে চলবে না, গত ৩০ বছরে পোষমানা কয়টি বিরোধী দল ছাড়া কোনো পলিটিক্যাল পার্টিকে মাথা তুলতে দেননি মোবারক। রাজনীতিহীনতার এই প্রগাঢ় সংকট আন্দোলনে অংশ নেওয়া নানা পক্ষের নানা ভুল তৎপরতায় দগদগে হয়ে ফুটে বেরিয়েছে। ধরা যাক ২০০৮ সালের এপ্রিলে আল মাহাল্লা আল কুবরা শহরে ধর্মঘটে ইচ্ছুক শ্রমিকদের সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা ফেসবুক-নির্ভর সংগঠন এপ্রিল সিক্স ইয়ুথ মুভমেন্টের কথা। 
মোবারকি শাসন অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এই সংগঠনের ‘ফাউন্ডেশন স্টেইটমেন্ট’-এ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থাকার কথা বলা হয়েছে। ভালো কথা। কিন্তু একই লাইনে আরও বলা হচ্ছে, এপ্রিল সিক্স কোনো রাজনৈতিক ধারা বা রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িত নয়। আরও লেখা আছে, কোনো মতাদর্শের পক্ষ নিয়ে সে মতাদর্শকে সঠিক প্রমাণ বা অন্য মতাদর্শকে ভুল প্রমাণের তর্ক-বিতর্কও এই সংগঠনে নিষিদ্ধ। তাহলে কী দাঁড়াল? কলুর বলদের মতো মোবারকবিরোধিতার ঘানি টানাকে কী বলা যায়? দল না থাকুক, কিন্তু কোনো ধারা বা আন্দোলনের পক্ষ-বিপক্ষ না নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অদল-বদলের যুদ্ধে নামাটাকে রাজনৈতিক নাবালকত্ব ছাড়া আর কী বলা যাবে? এখানেই শেষ নয়। এখন তো চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে ক্ষমতা জনতার হাতে নেই। কিন্তু এপ্রিল সিক্স বুধবার আরও একবার ‘সম্মানিত সামরিক বাহিনীর প্রতি পূর্ণ আস্থা থাকার’ কথা জানিয়ে দিয়েছে। এই অপরিপক্বতা ভয়াবহ। 
হয়তো সত্য, এপ্রিল সিক্স মিসরীয় রাজনীতিক-সংস্কৃতির পূর্ণ চিত্র দেয় না। কিন্তু মোবারকের বিদায়ের আগে মিলিটারিকে মহান মুক্তিদাতা হিসেবে ধরে নেওয়া কিংবা মোবারকের বিদায় অন্তে বলতে গেলে তেমন কোনো প্রতিবাদ না করেই সুবোধভাবে ঘরে ফিরে যাওয়ার মধ্যে মিসরীয় সমাজে রাজনৈতিক সংস্কৃতির দীনতার কথাই জানান দেয়। মোবারকবিরোধী আন্দোলনের প্রভাব আরব বিশ্বে হতে পারে সুদূরপ্রসারী। কিন্তু মোবারক নামের অচলায়তন হটাতে গিয়ে মিসরীয়রা মিলিটারি শাসনের গভীর খাদে পড়ে গেল কি না, তা সময় বলে দেবে। 
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১১

শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।

উচ্চাশা নয়, কিছু প্রত্যাশা আছে


  • আমরা দেখতে চাই এমন একটি জাতীয় সংসদ, যা বৈষম্য নির্মূলে ভূমিকা না রাখতে পারলেও দারিদ্র্যবিমোচনে ��
    আমরা দেখতে চাই এমন একটি জাতীয় সংসদ, যা বৈষম্য নির্মূলে ভূমিকা না রাখতে পারলেও দারিদ্র্যবিমোচনে সক্ষম
1 2
যাঁরা সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রদেহে বিদ্যমান যাবতীয় সমস্যা সমাধানের খোয়াব দেখেন, তাঁরা ধন্য। এ ধরনের লোক কম নেই বাংলাদেশে। সংসদীয় গণতন্ত্র তার ইতিহাসে যেসব বিষয়ে কখনো কোনো অঙ্গীকার করেনি, সেসব দিকেও আমাদের আশাবাদের ঘোড়াটিকে পরোক্ষে তাড়িত করেন এসব লোক। কেন, কে জানে! কথায় কথায় সংসদীয় গণতন্ত্র, সংসদীয় গণতন্ত্র! সমস্যা দেখলেই সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যর্থতা! কদাচ সাফল্যের দেখা পেলে সংসদীয় গণতন্ত্রের অবদান! অতিরিক্ত ব্যবহার আর অযথা প্রত্যাশার চাপে পড়ে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সম্ভাবনার দিকটি আজ বহুলাংশেই কতগুলো নিয়ম-কানুনসর্বস্ব শাস্ত্র-বচনে পর্যবসিত; আর চর্চার ক্ষেত্রের সীমাহীন ব্যর্থতার প্রসঙ্গটি আলোচনাই অর্থহীন।
‘স্বপ্নের জাতীয় সংসদ’ ভাবনাটির সঙ্গে এই প্রবন্ধকারের ভিন্নমত আছে; এই প্রবন্ধকারের মতে, সংসদীয় ব্যবস্থা কখনো ‘স্বপ্নের মতো সুন্দর’ হতে পারে না।
কারণ? সংসদীয় গণতন্ত্র বৈষম্যনির্ভর ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে পারে কি? ছোটলোকবান্ধব ব্যবস্থা কার্যকর করতে পারে? পারে কি উপহার দিতে সাম্য, যা দ্বারা মানুষ অন্যান্য জীবের তুলনায় নিজেকে প্রমাণ করতে পারে শ্রেষ্ঠতর? পারে না। অতীতে কোথাও পারেনি, এখনো পারে না। ১৮৩২ সালে যখন গ্রেট রিফর্ম অ্যাক্টের মধ্য দিয়ে ব্রিটেনে পার্লামেন্টারি-ব্যবস্থার একাধিপত্য চূড়ান্ত হয়, তখন থেকে হিসাব ধরলে কিংবা ফ্রান্সে ১৮৭০ সালে সূচিত হওয়া সাত দশক দীর্ঘ ফরাসি পার্লামেন্টারি-ব্যবস্থার স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত থার্ড রিপাবলিকের ইতিহাসের দিকে তাকালেও একই উত্তর পাওয়া যাবে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলে এর ব্যতিক্রম ঘটবে, তা মনে করার কোনো কারণ অতীত বা বর্তমানে একেবারেই ঘটেনি। 
ব্রিটিশ কলোনিকালে শাসনতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক এলিটদের শাসনব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বের দাবিদাওয়া আর সংগ্রামের ইতিহাস কী বলে? ১৯০৮ সালের মর্লি-মিন্টো অ্যাক্ট, ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড অ্যাক্ট কিংবা ১৯৩৫ সালের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট কী বলে? বলে এই কথাটিই যে উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক এলিটরা শাসনের শৃঙ্খল শিথিল করতে চেয়েছেন, এলিটরা শাসন প্রণালির মধ্যে জনগণের নামে আসলে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব দেখতে চেয়েছেন। দীর্ঘমেয়াদি নানা রাজনৈতিক ধস্তাধস্তির পরে ঔপনিবেশিক প্রভুরা এসব অ্যাক্টের মধ্য দিয়ে সামান্য মাত্রার যে ছাড়গুলো দিতেন, সেগুলোতে প্রতিনিধিত্ব বলতে মূলত এলিটদের প্রতিনিধিত্ব বোঝাত। পরবর্তী পর্যায়েও দেখা যাবে একই চিত্র। 
পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ অর্জনের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে একটি প্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থার স্বপ্ন যুক্ত ছিল, এটা ঠিক। কিন্তু মূলত জাতীয়তাবাদের রাজনীতিনির্ভর এই আন্দোলন-সংগ্রাম পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালিদের শাসন-শোষণ অবসানের বিরোধিতাকে মূল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলেও শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতার কারণে বৈষম্য অবসানের প্রশ্নটিকে কখনোই প্রধান করে তোলেনি। সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসকে উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর সঙ্গে যুক্ত করে বিবেচনায় নিলে সংসদীয় ব্যবস্থা তথা জাতীয় সংসদ একদিন না একদিন ‘স্বপ্নের মতো সুন্দর’ হয়ে উঠবে—এমনটি মনে করা মুশকিল।
তাই বলে কি সংসদীয় ব্যবস্থা তথা জাতীয় সংসদ নিয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই? অবশ্যই আছে; তবে এই বক্তব্য অবশ্যই সংসদীয় ব্যবস্থার সাধ্যের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে। কোনো লাভ নেই ‘আশার ছলনে ভুলি’। এমতাবস্থায় আলোচ্য হচ্ছে এমন একটি সংসদ, ‘যা হয়তো আমরা বর্তমানে পাই না, কিন্তু যা আমরা পেতে চাই’। প্রসঙ্গত, আরও বিবেচ্য, আমরা ‘কেমন জাতীয় সংসদ দেখতে চাই’। বুর্জোয়া প্রাধান্যাধীন সংসদীয় শাসন প্রণালিতে সাম্য, অসাম্য, বৈষম্যের মতো বিষয়গুলোর ফয়সালা হয়ে যাবে—এমন উচ্চাশা পোষণ না করাটাই যৌক্তিক। তাই আমরা দেখতে চাই এমন একটি জাতীয় সংসদ, যা বৈষম্য নির্মূলে ভূমিকা না রাখতে পারলেও দারিদ্র্যবিমোচনে সক্ষম। 
গুলিয়ে ফেলা যাবে না; বৈষম্যের অবসান আর গরিবি হটানো এক কথা নয়। গরিবির অবসান হলেই বৈষম্যের অবসান হয় না। পশ্চিমের ধনী দেশগুলো দারিদ্র্যপীড়িত নয়, কিন্তু নিদারুণ মাত্রায় বৈষম্যে আক্রান্ত। বৈষম্য অবসানের রাজনীতি তথা তরিকা ভিন্ন এবং এটি মানবেতিহাসের অগ্রগতিমুখীন অনেক বড় একটি প্রকল্প; সংসদীয় ব্যবস্থার সাধ্য নেই সেই পথে হাঁটার। শ্রেণীগত কারণেই সংসদীয় রাজনীতির মধ্য দিয়ে এটি অর্জন করা সম্ভব নয়। কিন্তু বুর্জোয়া ব্যবস্থাধীন সংসদীয় প্রণালির মধ্যে থেকেই দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব; পশ্চিম ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর ইতিহাস তা-ই বলে। স্বাধীনতার চার দশক হয়ে গেল; দারিদ্র্যবিমোচনের মতো একটি কাজ সম্পন্ন করাতে এত দেরি কেন বাংলাদেশে? সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান খুঁজতে চাওয়া লোকজনের এ প্রসঙ্গে ভাবা দরকার।
সেনা-নিয়ন্ত্রিত এক-এগারোর বছর দুয়েকসহ সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দুই দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনো কথায় কথায় সামরিক আমলে রাষ্ট্রযন্ত্রের যে বড় ক্ষতিগুলো করা হয়েছে, সেগুলোর দোহাই পাড়লে চলবে কেন? যদিও এ কথা সত্য যে সেনাপতিদের শাসনামলে সৃষ্ট বৈশ্বিক পুঁজিবাদের দাসানুদাস হিসেবে মালপানি কামাই করা এবং এখন অবধি মানসিকতার দিক থেকে সামন্তবাদী থেকে যাওয়া বিকটমূর্তি লুম্পেন বণিকেরাই এখন বাংলাদেশের নিয়ন্তা। জাতীয় সংসদকে খিস্তিখেউড়ের আখড়া বানিয়ে ফেলা থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীনদের যথেচ্ছাচার আর সংসদীয় অধিকারের নামে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ অব্যাহত রেখেই প্রধান বিরোধী দলের টানা সংসদ বর্জনের মতো অরাজকতার মধ্যে বাংলাদেশের অধিপতি শ্রেণীটির চরিত্র সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। 
প্রসঙ্গত, বর্তমান জাতীয় সংসদ সদস্যদের ৫৬ শতাংশ হচ্ছেন বণিক; এঁরা আসলে বড় বণিক বা অতি বড় বণিক। আমরা চাই বাংলাদেশের বুর্জোয়ারা প্রকৃত অর্থে বুর্জোয়া হয়ে উঠুক। অতি সস্তা শ্রমের দাস-মালিকসুলভ ব্যবহার, কমিশনবাজি, টেন্ডারবাজি করে কার্যত ঝুঁকিহীন মুফতে কামাইয়ের জোরে রমারমা লুম্পেন বুর্জোয়ার জায়গায় জাতীয় বুর্জোয়ার উদ্ভব ঘটুক। বর্তমান বিশ্ব-বাস্তবতায় তা আদৌ সম্ভব কি না, বলা মুশকিল; কিন্তু সংসদীয় ব্যবস্থায় ভদ্রলোকিয়ানা এবং গণমানুষের স্বার্থের কিছু মাত্রার প্রতিফলন দেখাতে হলে অধিপতি শ্রেণীটির সত্যিকারের বুর্জোয়া হয়ে ওঠার বিকল্প নেই। 
সুশীল সমাজ, থিংক ট্যাংকের কথামালা কিংবা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সুশীল সাংসদ তৈরির চেষ্টা খুব একটা কাজে আসবে বলে মনে হয় না। বরং সত্যিকারের বুর্জোয়ার উদ্ভব ঘটলে এর প্রতিফলন অর্থনীতির হাত ধরে অবধারিতভাবে রাজনীতিতে পড়বে, এমত আশাবাদের ভিত্তি আছে। এই বুর্জোয়ারা শ্রেণীস্বার্থেই সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে সচেষ্ট হবে; তাদের খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট হবে, যাতে করে দীর্ঘ মেয়াদে শ্রম শোষণ করে নিয়মবদ্ধ উপায়ে মুনাফা করা যায়। সামন্তবাদের তুলনায় পুঁজিবাদ এই জায়গাটিতে উন্নত। সামন্তপ্রভু তাঁর প্রজাকে যথেচ্ছ শোষণ করে স্বল্পতম সময়ে সর্বোচ্চ রস নিংড়ে নেওয়ার কায়দা করে; নিজেদের বানানো আইন নিজেরাই যখন-তখন মাড়ায়। পক্ষান্তরে ‘ভালো’ বুর্জোয়ারা বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি না হলে এ রকম করে না। বরং মানবিক মুখোশ পরিয়ে আইনকানুন, নিয়ম-নির্দেশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ সংস্থাগুলো তথা রাষ্ট্রযন্ত্রকে বুর্জোয়াদের উপযোগী করে সাজিয়ে নেয়।
জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার; জাতির স্বার্থের নাম করে বড়লোকের স্বার্থ দেখাটাই হচ্ছে স্বাভাবিকতা; অন্য কিছু স্বপ্ন দেখা বা দেখানোটাই হচ্ছে অস্বাভাবিকতা। ‘কেমন জাতীয় সংসদ দেখতে চাই বা পেতে চাই’ শীর্ষক জিজ্ঞাসার একটি জবাব হচ্ছে, আমরা প্রকৃত বুর্জোয়াদের প্রাধান্য বা প্রতিনিধিত্বশীল একটি জাতীয় সংসদ চাই; অর্থাৎ যে শ্রেণীর হাত ধরে সংসদীয় ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে, ইতিহাসে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আমরা সেই শ্রেণীটির প্রাধান্য বা প্রতিনিধিত্ব দেখতে চাই।
আমরা এমন একটি সংসদীয় শাসনব্যবস্থা দেখতে চাই, যাতে সরকারি ও বিরোধীদলীয় সাংসদেরা উপরিতলে বিরাজমান বিভেদটুকু ভুলে গিয়ে মেহগনি, শুল্কমুক্ত গাড়ি, জমি-ফ্ল্যাট বরাদ্দ কিংবা ভাতা বৃদ্ধির প্রশ্নে একযোগে তৎপর থাকবে না। আমরা এমন একটি সংসদীয় রাজনীতি চাই, যা সমতা আনতে না পারুক, জনসাধারণের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। এমন একটি সংসদীয় ব্যবস্থার আশা পোষণ করা কি অন্যায় হবে, যে ব্যবস্থা নয়া উদারনৈতিক তাত্ত্বিক কাঠামোর ভয়াবহতা অনুধাবন করতে একে ছুড়ে ফেলে দিতে সক্ষম? 
আর্থসামাজিক পরিস্থিতি অনুযায়ী ভূমি সংস্কার, ব্যাটাতন্ত্রের প্রকোপ হ্রাস, সাধারণ শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ, সেনায়িত সমাজে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নির্মূল করা, ধর্মীয় উগ্রবাদের অবসান ঘটানোর মতো কাজগুলো সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অধীনে থেকেই সম্পন্ন করা সম্ভব। অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে এসব মিশন অনেক আগেই সম্পন্ন হয়েছে। বৈষম্য অবসানের মতো বিশাল দায়িত্ব নয়, ন্যূনতম সম্মানের সঙ্গে মানুষের বেঁচে-বর্তে থাকার স্বার্থে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতি উল্লিখিত কাজগুলো সম্পন্ন করুক—এটুকুই প্রত্যাশা। 
প্রথম আলোর গতবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ‘বাকবাকুম’ শুনতে পাওয়ার কথা লিখেছিলাম। প্রকৃত প্রস্তাবে অর্থহীন; শুধুই গলা ফুলানো কথাবার্তা। মূলধারার রাজনীতিতে গত এক বছরে গণতন্ত্র প্রসঙ্গে ‘বাকবাকুম’ উপমা ব্যবহার ভুলিয়ে দেওয়ার মতো এতটুকু অগ্রগতি ঘটেছে বলে মনে হয় না। বরং অবস্থাদৃষ্টে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে উচ্চাশা তো নয়ই, কিছু প্রত্যাশা রাখতেও অনীহা জাগে।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।

বিলেতের কলেজ, হুঁশিয়ার!



শান্তনু মজুমদার | তারিখ: ২০-১০-২০০৯
ক্ষুধাপেটে লন্ডনের টিউব স্টেশনে বা পার্কে বসে থাকে বাংলাদেশ থেকে স্টুডেন্ট ভিসায় আসা অনেক তরুণ। সামান্য খাবার আর মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়ার আশায় পূর্ব লন্ডনের একাধিক মসজিদে আশ্রয় নিচ্ছে তারা। যেনতেন মজুরিতে একটি কাজের জন্য বাঙালিদের পরিচালিত জব সেন্টারগুলোতে সারা দিন চষে বেড়াচ্ছে স্টুডেন্ট ভিসায় আসা এসব তরুণ। শুধু থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে বাঙালি মালিকানার ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলোতে কাজের খোঁজে মরিয়া হয়ে আছে এসব তরুণ। এগুলো কোনো বানানো বা বাড়িয়ে বলা গল্প নয়। কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্রিকলেইন, হোয়াইট চ্যাপেলসহ পূর্ব লন্ডনের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে এসব দৃশ্য চোখে পড়ছে। অসমর্থিত সূত্রে প্রকাশ, উপায়ন্তর না দেখে দু-একজন নাকি রাস্তায় মানুষজনের কাছ হাত পাততে শুরু করেছে। এটা নিছক গুজব হতে পারে। তবে পরিস্থিতি কোথায় ঠেকলে এ ধরনের গুজব ছড়ায়?
নিজের খরচে থাকা-খাওয়ার অঙ্গীকার করে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে বিলেতের কলেজগুলোতে আসার আগে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর তরুণ-তরুণীদের কয়েকটি বিষয় অবশ্যই বিবেচনা করা দরকার। পরিবারের সম্বল জমিটুকু বর্গা দিয়ে কিংবা বাবার পেনশনের টাকা খরচ করে স্টুডেন্ট ভিসা জোগাড়কারীদের সঙ্গে ইতিমধ্যে আমাদের লন্ডন শহরে দেখা হয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে, প্রয়োজন পড়লে বাড়ি থেকে যাদের জন্য অর্থ-কড়ি আসবে এবং যাদের জন্য আসবে না, এই দুই গ্রুপের ঝুঁকির মাত্রা আলাদা।
বিলেতের বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, স্টুডেন্ট ভিসায় এসে আপনি কত দিনে দিন-চালানোর মতো একটি কাজ পাবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং অনির্ধারিত একটি সময় পর্যন্ত থাকা-খাওয়া-যাতায়াত খরচের প্রস্তুতি থাকা চাই। শীত চলে এসেছে। গ্যাস-লাইট খরচ বেড়ে যাবে বিধায় আবাসন খরচ কিছুটা হলেও বাড়বে এখন থেকে। ‘একবার পৌঁছাতে পারলে হয়, তারপর একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে’ মার্কা ‘আশ্বাস বাণী’র ওপর নির্ভর করে বিলেতে আসাটা সাধারণ ঘরের শিক্ষার্থীদের এখন ঠিক হবে না। আসতে চাইলে আসতে হবে সোজা কথায় নিজের টাঁকের ওপর নির্ভর করে।
মন্দার কারণে ব্রিটেনের ছোট-বড় সব ধরনের চাকরির বাজার খুবই খারাপ। হাতেগোনা ব্যতিক্রম বাদ দিলে চলছে ছাঁটাই আর শ্রমঘণ্টা কমিয়ে দেওয়ার পর্ব। পুরো ব্রিটেনের ব্যাপারে বলা যাচ্ছে না, তবে লন্ডনে বাঙালি শিক্ষার্থীদের কাজের জায়গাগুলো মোটামুটি নির্ধারিত। রিটেইল শপের মধ্যে মূলত সেইন্সবুরিস আর টেসকো, ফাস্টফুডের মধ্যে আছে কেএফসি আর ম্যাকডোনাল্ডস। এই সেদিন পর্যন্ত দুটো বৈকালিক ফ্রি পত্রিকা ছিল: লন্ডন লাইটস ও লন্ডন পেপার। শেষেরটি বন্ধ হয়েছে গত মাসের মাঝামাঝিতে, সঙ্গে করে নিয়ে গেছে বেশ কিছু বাঙালি ছাত্রছাত্রীর কাজের সুযোগ। যতটুকু জানা যায়, সামান্য বেতন ও মূলত কমিশনের ভিত্তিতে গ্যাস-বিদ্যুত্-টেলিফোনের মতো সেবাগুলোর জন্য গ্রাহক জোগাড়ের কাজও করে কিছু বাঙালি শিক্ষার্থী। আর বাকি থাকল ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলো। বেশির ভাগই বাঙালি মালিকানাধীন হওয়ার কারণে অনেক বাঙালি শিক্ষার্থীর জন্য এত দিন পর্যন্ত পছন্দ-অপছন্দ মিলিয়ে এক ধরনের ভরসার জায়গা ছিল রেস্টুরেন্টগুলো। এর বাইরেও বহু জায়গাতেই বাঙালি শিক্ষার্থীরা কাজকর্ম করলেও, দলে দলে কাজ করার সুযোগ পাওয়ার মতো প্রতিষ্ঠান সম্ভবত এ কটিই। শোনা যায়, নানা কিসিমের বাণিজ্যিক উদ্যোগের সঙ্গেও বিভিন্নভাবে জড়িত হয়েছে কেউ কেউ। 
ব্যাপার হলো, ওপরে উল্লিখিত প্রতিটি ক্ষেত্রেই মন্দাজনিত কারণে কাজের সুযোগ কমেই চলছে। এ ছাড়া রিটেইল বা ফাস্টফুড চেইনগুলো নিয়োগদানের ক্ষেত্রে ক্রমেই অনলাইন আবেদন পদ্ধতির দিকে ঝুঁকতে থাকার কারণে ‘দেশি ভাই, দেশি বোন’ ধরে বাঙালি শিক্ষার্থীদের টুকটাক চাকরি পাওয়ার সুযোগও কমে গেছে ব্যাপকভাবে। এ ছাড়া ভাষা ব্যবহারে অধিকাংশের মধ্যেই কম-বেশি সমস্যা। বিলেতে কাজের অভিজ্ঞতার অভাব আর শিক্ষার্থীদের জন্য সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে না পারার আইনটি ইদানীং বেশ কড়া হয়ে ওঠার বাস্তবতায় নবাগতদের জন্য পরিস্থিতি যে তুলনামূলকভাবে কঠিন, তা বোধের অগম্য হওয়ার কারণ নেই।
এর আগেও বিচার-বিবেচনার ব্যাপার আছে। কলেজগুলোতে ভর্তি হয়ে স্টুডেন্ট ভিসা নেওয়ার তোড়জোড় করার আগে খুব ভালোভাবে, আসলেই খুব ভালোভাবে খোঁজখবর করাটা খুব জরুরি। পড়ালেখার ইচ্ছা থাকলে, আবার লিখছি লেখাপড়ার ইচ্ছা থাকলে এজেন্সিগুলোর কথায় মুগ্ধ হয়ে তাড়াহুড়ো করা যাবে না। এমনকি কলেজগুলোর সুন্দর সুন্দর ওয়েবসাইটের ওপরও পুরো নির্ভর না করে পরিচিত কেউ থাকলে তাদের মাধ্যমে খবর নেওয়াটা জরুরি। পরিচিতদের কাছে কলেজের ফটো পাঠানো বা ইউটিউবে খানিকটা ভিডিও আপলোড করার অনুরোধ করা যেতে পারে। মাল্টিম্যাপ ডটকম নামের ওয়েবসাইটিতে ঢুকে পোস্টকোডটি টাইপ করে কলেজটি কোনো এলাকায় অবস্থিত বা আশপাশের এলাকা সম্পর্কে হালকা একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। এটা বিশেষ কিছু না, তবে আজকাল কোথাও যাওয়ার আগে ব্রিটেনের মতো দেশে, এটা একটা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সার্চইঞ্জিন গুগুল ব্যবহার করেও এ ক্ষেত্রে কিছু সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। মোট কথা, প্রতিষ্ঠানের আকার-আয়তন, মালিকানা, পাঠদানের মান, পাঠদানকারীদের বিস্তারিত বিবরণ—এসব ব্যাপারে যত বেশি জেনে নেওয়া যায়, ততই ভালো। উল্লেখ্য, কোনো কোনো কলেজের ওয়েবসাইটে বিভ্রান্তিকর তথ্য ও ফটো আপলোড করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
সামপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে পূর্ব লন্ডনের কলেজগুলোতে পড়তে আসা বহু শিক্ষার্থীর কাছ থেকে অবিশ্বাস্য অঙ্কের খরচের খবর পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ টিউশন ফি, এজেন্সির কমিশন, বিমান ভাড়াসহ যাবতীয় ব্যয় বাবদ আট থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ হয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। এসব খবরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন থাকলেও হয়তো থাকতে পারে; তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা খরচ করে লন্ডনের কলেজে পড়তে আসে। কাজকর্ম পাওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ণ-অনিশ্চয়তার মুখে শুরুতেই এত বড় বিনিয়োগ শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে ঠেকাবে সে ব্যাপারে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের অবশ্যই ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। বর্তমানে ইনস্টিটিউট অব কমনওয়েলথ স্টাডিজে গবেষণারত।

মোবারক থেকে মিলিটারি



শান্তনু মজুমদার | তারিখ: ২০-০২-২০১১
আচমকা তেড়েফুঁড়ে ওঠা জনতার তোপে কোনো এক শাসকের পতন সত্যিকার অর্থে কতটুকু মানে তৈরি করে? গত কয়েক দিনে মিসরের ঘটনাপ্রবাহ অবধারিতভাবেই এ প্রশ্নের সামনে টেনে দাঁড় করায় আমাদের। ক্ষমতা কেমন করে বলতে গেলে আপসে স্বৈরাচারের হাত থেকে সেনার কোলে উঠে পড়তে পারে, তা কয়েক দিন আগে প্রত্যক্ষ করা গেল মিসরে। মোবারক থেকে মিলিটারির হাতে পড়া মিসরের ঘটনাপ্রবাহ এই বার্তা দেয়, সুচিন্তিত সাংগঠনিক প্রস্তুতি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও প্রশিক্ষণসম্পন্ন নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে হাজারও ন্যায্য কারণে ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ-রুষ্ট বিপুলসংখ্যক মানুষ মহা ভূমিকম্পের মতো গর্জে উঠে দ্রুতই দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে দিতে পারলেও তাদের অর্জন বেহাত হয়ে যেতে পারে ততধিক দ্রুততায়। 
মিসরের ঘটনার প্রভাব আরব বিশ্বে কেমন হবে, তা সময় বলে দেবে। তবে এটা স্পষ্ট যে মিসরে দেড় পক্ষব্যাপী পলিটিক্যাল মেলোড্রামার আপাত-অবসান হয়েছে মিলিটারির হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। গত শুক্রবার মোবারকি শাসন অবসানের ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে দেশটিতে মিলিটারি শাসনের প্রাথমিক বিকারগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করে। অবশ্য এতে আশ্চর্য হওয়ার অবকাশ নেই একেবারেই। মোবারকের গদি ছাড়ার কয়েক দিন আগে থেকে জনতা আর অপজিশন-এলিটদের মিলিটারি-বন্দনা প্রকাশ্য রূপ নেয়। ‘গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের’ পথে সুদৃঢ় ভূমিকা নেওয়ার জন্য মিসরীয় মিলিটারির প্রতি বারাক ওবামার উদাত্ত আহ্বান জানানোর রাজনীতি বোঝা তেমন কঠিন নয়—একসময় আফগানিস্তানে মার্ক্সবাদ ঠেকাতে মৌলবাদ কাজে লেগেছিল; মিসরে মৌলবাদ ঠেকাতে মিলিটারি থেরাপি ভাবা হচ্ছে বলে মনে করা হয়। আচমকা দৃশ্যপটে উদিত এলবারাদি মোবারকের গড়িমসিতে দৃশ্যত ত্যক্ত হয়ে প্রকাশ্যে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে দু-একটি কড়া উক্তি করলেও মিলিটারিকে তিনিও স্বাগত জানান। এখন অবশ্য মিলিটারি ‘যোগ্য’ প্রতিদান দিচ্ছে। কমান্ডাররা জানাচ্ছেন, সামনের দিনগুলোতে তাঁরা দৃশ্যপটে বারাদিকে চাইছেন না। মিলিটারি সম্ভবত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাতে চাইবে যে বারাদিকে টেবিলে না রেখেও অগ্রসর হওয়া যায়। এতে করে পরিস্থিতির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণের একটা প্রমাণ দেখানো যাবে। এ ছাড়া মুরব্বিদের সামনে নিজেদের প্রয়োজনীয়তা অধিক কার্যকরভাবে বাজারজাত করা যাবে। আরও লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, বারাদিকে আলোচনার টেবিলে ডাকা না হলেও নিষিদ্ধ মুসলিম ব্রাদারহুডের লোকজনের সঙ্গে কমান্ডারদের বৈঠক ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। ব্রাদারহুডের বৈঠকে যাওয়াটাও নব্য-ক্ষমতাধারীদের জন্য প্লাস পয়েন্ট। এর মাধ্যমে প্রভু রাষ্ট্রকে এই মর্মে প্রমাণ করা যাবে যে মিলিটারি ব্রাদারহুডিদের সঙ্গে সমঝে চলায় সক্ষম। 
বারাদি নাহয় বাইরের শক্তির সমীকরণের অন্তর্ভুক্ত এক ঘুঁটি। কিন্তু ১৮ দিনের আন্দোলনকালে মিসরীয়দের মধ্যে মিলিটারিপ্রীতির যে নমুনা দেখা গেছে, তার ব্যাখ্যা কী? মনে কি পড়ে না কায়রোর রাস্তায় কামানের গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে পলিটিক্যালি অশুদ্ধ নৃত্য ও উল্লাসের ঘটনা? এই তো গত সপ্তাহের ঘটনা। মিলিটারির ক্ষমতা কুক্ষীকরণ-প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার কিছু কণ্ঠ এখনো শোনা যাচ্ছে। তবে এদের জন্য পত্রিকার পাতায় লাইন আর টিভি রিপোর্টিংয়ে সময় বরাদ্দ—দুটোই কমে যাচ্ছে। কেননা বাস্তবতা এই যে, অর্জিত বিজয় সংহত হওয়ার আগেই জনতা রাজপথ থেকে ঘরে ফিরে গেছে। স্বল্পসংখ্যক ভিন্ন স্বরের জন্য মিডিয়া সার্বক্ষণিকভাবে ব্যতিব্যস্ত থাকবে, তা আশা করা যায় না। মোবারক হটানো মিসরীয়দের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলা যায়, আন্দোলনে অর্জিত ‘লাভের গুড়’ এখন ‘পিঁপড়ায়’ খেতে শুরু করেছে।
মিসরের সর্বশেষ পরিস্থিতির আরও একটি লক্ষণীয় দিক হলো, ক্ষমতা হাতে পাওয়া মাত্রই মোবারকবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ভেদ তৈরিতে সচেষ্ট হয়েছে মিলিটারি। বিশেষ করে সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় কাদের ডাকা হচ্ছে না বা হচ্ছে, তা নিয়ে মোবারকবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া নানা ছোট-বড় গ্রুপের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস দানা বেঁধে উঠতে শুরু করেছে বলে ধারণা দিয়েছে কোনো কোনো মিডিয়া। 
আরেকটি ব্যাপার ভুলে গেলে চলবে না, গত ৩০ বছরে পোষমানা কয়টি বিরোধী দল ছাড়া কোনো পলিটিক্যাল পার্টিকে মাথা তুলতে দেননি মোবারক। রাজনীতিহীনতার এই প্রগাঢ় সংকট আন্দোলনে অংশ নেওয়া নানা পক্ষের নানা ভুল তৎপরতায় দগদগে হয়ে ফুটে বেরিয়েছে। ধরা যাক ২০০৮ সালের এপ্রিলে আল মাহাল্লা আল কুবরা শহরে ধর্মঘটে ইচ্ছুক শ্রমিকদের সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা ফেসবুক-নির্ভর সংগঠন এপ্রিল সিক্স ইয়ুথ মুভমেন্টের কথা। 
মোবারকি শাসন অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এই সংগঠনের ‘ফাউন্ডেশন স্টেইটমেন্ট’-এ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থাকার কথা বলা হয়েছে। ভালো কথা। কিন্তু একই লাইনে আরও বলা হচ্ছে, এপ্রিল সিক্স কোনো রাজনৈতিক ধারা বা রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িত নয়। আরও লেখা আছে, কোনো মতাদর্শের পক্ষ নিয়ে সে মতাদর্শকে সঠিক প্রমাণ বা অন্য মতাদর্শকে ভুল প্রমাণের তর্ক-বিতর্কও এই সংগঠনে নিষিদ্ধ। তাহলে কী দাঁড়াল? কলুর বলদের মতো মোবারকবিরোধিতার ঘানি টানাকে কী বলা যায়? দল না থাকুক, কিন্তু কোনো ধারা বা আন্দোলনের পক্ষ-বিপক্ষ না নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অদল-বদলের যুদ্ধে নামাটাকে রাজনৈতিক নাবালকত্ব ছাড়া আর কী বলা যাবে? এখানেই শেষ নয়। এখন তো চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে ক্ষমতা জনতার হাতে নেই। কিন্তু এপ্রিল সিক্স বুধবার আরও একবার ‘সম্মানিত সামরিক বাহিনীর প্রতি পূর্ণ আস্থা থাকার’ কথা জানিয়ে দিয়েছে। এই অপরিপক্বতা ভয়াবহ। 
হয়তো সত্য, এপ্রিল সিক্স মিসরীয় রাজনীতিক-সংস্কৃতির পূর্ণ চিত্র দেয় না। কিন্তু মোবারকের বিদায়ের আগে মিলিটারিকে মহান মুক্তিদাতা হিসেবে ধরে নেওয়া কিংবা মোবারকের বিদায় অন্তে বলতে গেলে তেমন কোনো প্রতিবাদ না করেই সুবোধভাবে ঘরে ফিরে যাওয়ার মধ্যে মিসরীয় সমাজে রাজনৈতিক সংস্কৃতির দীনতার কথাই জানান দেয়। মোবারকবিরোধী আন্দোলনের প্রভাব আরব বিশ্বে হতে পারে সুদূরপ্রসারী। কিন্তু মোবারক নামের অচলায়তন হটাতে গিয়ে মিসরীয়রা মিলিটারি শাসনের গভীর খাদে পড়ে গেল কি না, তা সময় বলে দেবে। 
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১১
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।

সামাজিক শক্তি ও ধর্মনিরপেক্ষতা

এত দিন কোনো মুখোমুখি পরীক্ষা সে অর্থে হয়নি। কিন্তু এবার যখন ক্ষমতাসীনেরা সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনল, তখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেল, সামরিক আমল থেকে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধীদের প্রচার-প্রচারণা অত্যন্ত ফলবান হয়েছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধীদের ভয়ে এবার ক্ষমতাসীনেরা এমন এক ধর্মনিরপেক্ষতা উপহার দিলেন, যা পৃথিবীতে কেউ কখনো দেখেনি, কেউ কখনো শোনেওনি। একটি রাষ্ট্রধর্ম থাকবে, একটি নির্দিষ্ট ধর্মের বাণী উদ্ধৃত থাকবে এবং একই সঙ্গে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকবে—এর কোনো মানে হয় না। এটা কোথাও নেই। আমাদের দেশের বাস্তবতার দোহাই এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো মুশকিল। কারণ, কেউ যদি নিজেকে উদারনৈতিক গণতন্ত্রপ্রেমী মনে করেন, তাহলে নির্দিষ্ট বিরতিতে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিশ্বাস করাটা তাঁর জন্য প্রাথমিক শর্ত। ঠিক একইভাবে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করলে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো ধর্মকে প্রাধান্য না দেওয়াটাই হচ্ছে প্রাথমিক শর্ত। ধর্মনিরপেক্ষতা না চাইলে নেই, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা চাইলে এই প্রাথমিক শর্তটুকু পূরণ করাটা একান্ত আবশ্যক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রাথমিক শর্ত অগ্রাহ্য করেই বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রবিষ্ট হলো। 
নিরন্তর প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার বিশাল বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন বাংলাদেশের মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িকতাবাদী ও নব্য রক্ষণশীলেরা। ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধী প্রচারণায় মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক লাইনের লোকেদের কায়দাটি সোজাসাপটা। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাকে তাঁরা ধর্মহীনতা তথা নাস্তিকতা হিসেবে বর্ণনা করে ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। আর ধর্মনিরপেক্ষতা-সংক্রান্ত আলোচনাটি যে মূলত রাষ্ট্র-পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের অনুপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা-সংক্রান্ত, তা বেশির ভাগ সময় এড়িয়ে যান অথবা উল্লেখ করলেও নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা-বয়ান হাজির করেন। অন্যদিকে, নব্য রক্ষণশীলদের দাবি হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা পশ্চিমা আধুনিকতা-উদ্ভূত একটি ধারণা, যা আমাদের এখানে কাজ করে না। আশ্চর্যের বিষয় এই যে পশ্চিমা ধাঁচের রাষ্ট্রব্যবস্থা, পশ্চিম থেকে আসা বুর্জোয়া গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র বা পশ্চিমা সংস্কৃতির বিষয়ে এদের হঠাৎ হঠাৎ বিরোধিতা থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে ক্রোধের মাত্রাটি সর্বাধিক।
দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধিতার কুফল এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতেও ভয় বা জড়তায় ভোগেন। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে যেকোনো বার্তাকেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে চিত্রিত করার ক্ষেত্রে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছেন ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধীরা। এ ক্ষেত্রে পঁচাত্তরের পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধীদের রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তাপ্রাপ্তির বিষয়টি মাথায় রেখেও রাষ্ট্রকর্মে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজনসংক্রান্ত মূল কথাগুলো ধর্মপ্রাণ জনসাধারণের সামনে হাজির করার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাপন্থী সামাজিক শক্তিগুলোর দুর্বলতার বা ব্যর্থতার প্রসঙ্গটি স্মরণে রাখতেই হবে। এখন হঠাৎ করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করে বা দলটির ওপর অভিমান করে তেমন ফায়দা হবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক দলের মূল হিসাব থাকে ভোটের ব্যাপারে। আওয়ামী লীগ সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা আবার ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভোট-ব্যাংকের দিকে খেয়াল রাখছে—এতে আর বিচিত্র কী! 
লক্ষ করার ব্যাপার হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গটি সামনে এলে পক্ষ ও বিপক্ষ উভয়ই এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে সামনে রেখে অস্বাভাবিক স্পর্শকাতর এক পরিস্থিতির অবতারণা করে। যেন এ দেশ ছাড়া আর কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে কস্মিনকালেও ধর্মনিরপেক্ষতা চালু হওয়া দূরে থাকুক, এ নিয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। আসলে বাস্তব পরিস্থিতি কী? বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, ২০০৯ সালের এক হিসাবমতে ১৩টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির উল্লেখ ও ব্যাখ্যা আছে। দেশগুলো হচ্ছে: আজারবাইজান, বারকিনো ফাসো, চাদ, গায়না, কাজাখস্তান, কসোভো, কিরগিজস্তান, মালি, নাইজার, সেনেগাল, তাজাকিস্তান, তুরস্ক ও তুর্কমেনিস্তান। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশগুলোর কোনোটিই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের অজুহাত তুলে কোনো রাষ্ট্রধর্মের বিধান রাখেনি বা সংবিধানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মগ্রন্থ থেকে বাণী নিয়ে তা সংবিধানে যুক্ত করেনি। এসব দেশ ছাড়াও আরও ছয়টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ আছে, যেগুলোতে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রাধান্য পাওয়া কোনো ধর্ম নেই এবং যাদের লিগ্যাল সিস্টেম মোটের ওপর ধর্মনিরপেক্ষ। দেশগুলো হচ্ছে: আলবেনিয়া, গাম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লেবানন, সিয়েরা লিওন, সিরিয়া ও উজবেকিস্তান। দেখা যাচ্ছে, আরব অঞ্চল ছাড়া অন্য অঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতা স্বভাবজাত।
উল্লিখিত দেশগুলোর কয়েকটি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়ে রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, চাদের সংবিধানের ৩৫ নম্বর ধারায় রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিঘ্নিত করে এমন যেকোনো কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ মাত্রার রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। গায়না (ধারা ৯১) ও তাজিকিস্তানের (ধারা ১০০) মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের সংবিধান মোতাবেক ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ রিভিশনের বিষয় হতে পারে না। মালিতে (ধারা ২৫) ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ওপর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। নাইজারে (ধারা ৮ ও ৯) কোনো ধর্ম রাজনৈতিক ক্ষমতার দাবিদার হতে পারে না; এ ছাড়া দেশটিতে ধর্মীয় ভাবযুক্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। তাজিকিস্তানের (ধারা ৮ ও ২৬) সংবিধান রাষ্ট্রধর্মের বিধান নিষিদ্ধ করেছে; আর কোনো ব্যক্তি চাইলে দেশটিতে বিনা বাধায় ধর্মহীন জীবন যাপন করতে পারে। এসব ছাড়াও উল্লিখিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৯টি দেশের সংবিধানেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষা, আইন বা রাজনীতির ক্ষেত্রে নানা ধরনের সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা যুক্ত করা আছে।
স্বাভাবিক যে এসব দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা চ্যালেঞ্জবিহীন অবস্থায় নেই। চ্যালেঞ্জ থাকাটাই স্বাভাবিক। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ এসব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সাংবিধানিকভাবে টিকে আছে। এতগুলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সম্ভব হলে বাংলাদেশের সমস্যাটা কোথায়? সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতাধারী দল ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যা করল, তাতে ধর্মনিরপেক্ষতার সংগ্রাম জোরদার হওয়া দূরে থাকুক, সামনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনেরা কোনো ফায়দা ওঠাতে পারবে বলেও মনে হয় না। 
আসলে সামাজিক পর্যায়ে ব্যাপক আবেদন তৈরি করার কষ্টকর সংগ্রামের স্তর পার না হয়ে আদালত ও সংসদের ওপর ভর করে আর যা-ই হোক, টেকসই সাধারণভাবে গ্রাহ্য ধর্মনিরপেক্ষতার আশা করা অবান্তর। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবারের সংবিধান সংশোধনীতে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত না করলে ক্ষতি ছিল না। আরেকটা কথা হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধীরা ক্ষমতায় এলে টুটোফাটা এই ধর্মনিরপেক্ষতাটুকু রাখবে না এবং এই কর্ম করে তারা পার পেয়ে যাবে, যা উদাহরণস্বরূপ তুরস্কের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে সম্ভব নয়। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, গত তিন মেয়াদ দেশটিতে ধর্মবাদীরা ক্ষমতায়, কিন্তু প্রতি পদে তাদের বলতে হয় যে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে। এই হচ্ছে সমাজ দেহে কোনো একটি মতাদর্শকে প্রোথিত করতে পারার সুবিধা। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, তুর্কিরা অসম্ভব ধর্মপ্রাণ, কিন্তু তাদের অধিকাংশই রাষ্ট্রকর্মে ধর্মের উপস্থিতি চায় না। বাংলাদেশের জন্যও তো এটুকুই চাওয়া। কিন্তু তেমন কিছু হতে হলে শুধু রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা হবে না। ধর্মনিরপেক্ষতাপন্থী সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লম্বা সময় সামাজিক পরিসরে কাজ করতে হবে। তখন আর ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিকে গোঁজামিলের আশ্রয় নিতে হবে না; যেমনটি করা হয়েছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে।
শান্তনু মজুমদার: শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ধর্মনিরপেক্ষতা-বিষয়ক গবেষক।

‘খাঁটি’ মৌলবাদের প্রকোপ বৃদ্ধি ইসরায়েলে



শান্তনু মজুমদার | তারিখ: ৩১-১২-২০১১
ইসরায়েল শুরু থেকেই একটি মৌলবাদী রাষ্ট্র। এই মৌলবাদ জন্ম থেকে অন্য ধর্মাবলম্বী (সুনির্দিষ্টভাবে মুসলমান) অন্য জাতির (সুনির্দিষ্টভাবে আরব) মানুষজনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে হেনস্তা-শায়েস্তা করার রসদ জুগিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ২০০৯ সালে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে লিকুদ পার্টির সরকার গঠনের পর থেকে মৌলবাদ চর্চায় একটি বড় ধরনের পরিবর্তন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে দেশটিতে। এত দিন মৌলবাদী এজেন্ডাগুলো অন্য ধর্ম, অন্য জাতির বিরুদ্ধে ব্যবহার করে জায়নবাদ টিকিয়ে রাখায় রাজনীতিকেরা মূল ভূমিকা পালন করলেও এখন কট্টরপন্থী ধর্মগুরু এবং সাধারণ মৌলবাদীরা জোশের সঙ্গে মাঠে নেমেছেন। শুধু অন্য ধর্মাবলম্বী নয়, শুধু অন্য জাতি নয়, নিজ ধর্মের, নিজ জাতির মানুষকে যুগ-অনুপযোগী নিয়মকানুনের শিকলে বেঁধে ফেলতে চাইছে মৌলবাদীরা। বলা যায়, ইসরায়েলে খোদ ইহুদিরাই এখন ‘খাঁটি’ মৌলবাদী হিংস্রতার মুখোমুখি। 
গত কিছুদিন ধরে আট বছর বয়সী স্কুলছাত্রী নামা মার্গোলিসেকে নিয়ে যা করা হচ্ছে, তা ইসরায়েলে মৌলবাদীদের সাম্প্রতিক প্রকোপ বোঝার জন্য যথেষ্ট। ছোট্ট শহর বেইত সিমেশ এর ছোট্ট মেয়ে নামা মৌলবাদীদের জন্য স্কুলে যেতে পারে না স্বাভাবিকভাবে। নামা একটি ধর্মীয় স্কুলে যায় শিক্ষা নিতে এবং সে স্কুলে যাওয়ার জন্য তাকে লম্বা হাতার জামা ও স্কার্ট পরতে হয়। কিন্তু মৌলবাদীদের চোখে এটা যথেষ্ট নয়। এ জন্য স্কুলে যাওয়ার পথে নামার গায়ে থুতু ছিটাত, চিৎকার করে ‘বেশ্যা’ বলে গালি দিত; নামাকে তথাকথিত ‘শালীন’ পোশাক পরার জন্য হুমকি দিত মৌলবাদীরা। নামার ওপর মৌলবাদী নির্দয়তার খবর নিয়ে একটি টিভি চ্যানেলে প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়ার পর গত কয়েক দিন পরে মৌলবাদবিরোধী বাক-বিস্তার চলছে ব্যাপক হারে। কিন্তু এসব বাক-আস্ফাালনে মৌলবাদীদের হঠাৎ করে দুর্বল হয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই। বরং তারা প্রতিবাদ করতে আসা লোকজন এমনকি পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার সক্ষমতা দেখিয়েছে।
প্রসঙ্গত, বেইত সিমেশের মৌলবাদীরা অনেক দিন ধরেই নারী-পুরুষকে আলাদা ফুটপাতে হাঁটার আহ্বান সংবলিত নির্দেশিকা টানিয়েছে রাস্তায়, তারা ‘শালীনতা’ রক্ষার টহল নামিয়েছে এবং নির্দেশ অমান্যকারীদের দিকে পাথর ছুড়ছে। নারীদের প্রতি তথাকথিত ‘শালীন’ পোশাক পরার আহ্বান জানিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে আবাসিক এলাকাগুলোর দেয়াল। পুলিশ এত দিন এসব দেখেও দেখত না। চরম ডান ও কট্টর ধর্মবাদীদের সরকারের আমলে পুলিশের অবশ্য এসব দেখার কথাও নয়, নামার ঘটনা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে চলে আসায় অবশ্য নেতানিয়াহুকেও নিন্দা জানাতে হচ্ছে, যা কোনোভাবেই তার প্রাণের কথা হতে পারে না। গত মাসের শেষ দিকের ঘটনা, মিরিয়াম শিয়ার নামের এক তরুণীকে একটি পথচলতি বাসের পেছন দিকে বসার হুকুম করেন জনৈক ধর্মগুরু। কারণ, মিরিয়াম নারী। ধর্মগুরুর হুকুম অমান্য করায় মিরিয়ামকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করে কট্টর মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে হারেদি তরিকার লোকজন। 
লক্ষ করা যাচ্ছে, অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদীদের মতো ইহুদি মৌলবাদীরা সুনির্দিষ্টভাবে নারীর প্রতি বিরূপ। তাদের ফতোয়াদির মূল অংশই নারীবিদ্বেষী। উদাহরণস্বরূপ ইসরায়েলের মৌলবাদীদের একটি অংশ নারীকণ্ঠের গান শোনাকে পাপ হিসেবে ফতোয়া দিচ্ছে। এ ছাড়া নারী-পুরুষের যুগল কণ্ঠে ধর্মগীত, বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ডে নারীর মুখ দেখানোয় আপত্তি থেকে শুরু করে ইহুদি নারীকে কাপড়চোপড়ে পুরোপুরি আচ্ছাদিত করে দেওয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর অনুষ্ঠানে নারীকণ্ঠের গান না শোনার জন্যও ধর্মপ্রাণ সেনাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মৌলবাদীরা। এদের নারী বিদ্বেষ এতই প্রবল যে নারীকণ্ঠে গান শোনার আগে মৃত্যু বরণ করা শ্রেয় বলে ফতোয়া দিয়েছেন এক ধর্মগুরু। নেসেটে একজন নারীর বক্তৃতা শোনার ‘অপরাধে’ সম্প্র্রতি একটি প্রাক-মিলিটারি স্কুলের কিছু শিক্ষার্থীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন অপর এক ধর্মগুরু।
ইহুদি আইন হালাছাকে দৃশ্যত কঠিনভাবে মান্য করে জীবনযাপনকারী কিছু লোক ইসরায়েলে সব সময় ছিল। কিন্তু ভীতিকর ব্যাপার হচ্ছে, এই যে অধুনা এসব লোক হালাছাকে পুরো জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দিতে উদ্যত হচ্ছে। আর এ কাজে নীরব সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে সরকারের কাছ থেকে। আর এ সুযোগে মৌলবাদীরা তাদের প্রভাব বাড়িয়ে নিচ্ছে প্রতিদিন। ইহুদিদের বিয়েশাদির ক্ষেত্রেও মৌলবাদী হস্তক্ষেপ বেড়েছে অন্য ধর্ম, অন্য জাতির বিরুদ্ধে মৌলবাদ চর্চাকারী ইসরায়েলে। ইসরায়েলের ইহুদি মৌলবাদী ধর্মগুরুদের মতে, বিয়ে করার জন্য নিজেকে ইহুদি হিসেবে পরিগণিত করাতে চাইলে একজন ব্যক্তিকে কমপক্ষে তিন প্রজন্মের পুরোনো দালিলিক প্রমাণ দেখাতে হবে। প্রশ্ন উঠেছে, হলোকাস্টের সময় প্রাণ নিয়ে বেঁচে আসা ইহুদি পরিবারের লোকেরা এ প্রমাণ কীভাবে জোগাড় করবে? মৌলবাদীদের এসব যুক্তি বোঝানো যায়? আসলে যুক্তি হচ্ছে মৌলবাদের চূড়ান্ত প্রতিপক্ষ। 
নেতানিয়াহুর জামানাতে কট্টরপন্থীদের সাহস এতটাই বেড়েছে যে তারা মধ্যপন্থী ধর্মগুরুদের সংগঠন জোহারকে বিয়েশাদি পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি তুলছে। তারা আপাতত ব্যর্থ হলেও দাবি থেকে সরে আসেনি। এ ছাড়া ইদানীং ধর্মপন্থী জায়নবাদী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কট্টরতম হারেদিদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। হারেদি শিক্ষকেরা স্বাভাবিকতাবিমুখ, বিজ্ঞানমনস্কতার শত্রু উগ্র মৌলবাদী নতুন প্রজন্মের ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। নিখুঁতভাবে মগজ ধোলাই হয়ে যাওয়া নব্য মৌলবাদীরা যেকোনো রাষ্ট্রীয় আইন বা সামাজিক চর্চাকে ধর্মসম্মত মনে না হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। এভাবে স্বধর্মে মানুষেরাই ক্রমে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হতে থাকায় মৌলবাদী ইসরায়েল রাষ্ট্রের ভেতর থেকে ধসে যাওয়ার কাজটি ইহুদি মৌলবাদের হাতেও হতে পারে ভবিষ্যতে। 
ইসরায়েলে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিষয়াদিতে ইহুদি মৌলবাদীদের প্রভাব বৃদ্ধির বাস্তবতা অবশ্য এক দিনে তৈরি হয়নি। এ প্রসঙ্গে ২০০৫ সালে লিকুদ পার্টিতে ভাঙন, ২০০৬ সালের আইনসভা নির্বাচনে দলটির নিতান্ত বাজে ফল, ২০০৮ সালের শেষের দিকে সরকার টিকিয়ে রাখায় কাদিমা পার্টির ব্যর্থতা, ২০০৯ সালের শুরুতে লিকুদের নেতৃত্ব কোয়ালিশন সরকার গঠনের মতো বিষয়গুলো স্মরণে রাখতে হবে। ‘হিটনাটকুট’ বা ‘ডিসএনগেইজমেন্ট প্ল্যান’ ইস্যুতে মতবিরোধকে কেন্দ্র করে ২০০৫ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে লিকুদ থেকে বেরিয়ে যান উদারপন্থী অ্যারিয়েল শ্যারন। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শ্যারন ‘হিটনাটকুট’ বাস্তবায়িত করেন, যার আওতায় গাজা ও পশ্চিম তীরের উত্তরাংশ থেকে সব ইসরায়েলি বসত সরিয়ে নিয়ে আসা হয়। ‘হিটনাটকুট’ বাস্তবায়নের পরিণতিতে লিকুদে থাকতে না পেরে দলের উদারপন্থী ও মধ্যপন্থী দল লেবার পার্টির কিছু লোকজন সঙ্গে নিয়ে কাদিমা পার্টি গঠন করেন, ফলে লিকুদের ওপর নেতানিয়াহুর মতো চরম ডানপন্থীর একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি হয়। ‘হিটনাটকুট’-এর সময় ইহুদি উপাসনালয় ভেঙে ফেলার মতো স্পর্শকাতর ইস্যুকে নিয়ে সে সময় ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দেওয়ার কাজটি বেশ ভালোভাবে করেন নেতানিয়াহু, এ কাজে সহায়তা নেওয়া হয় কট্টরপন্থী ধর্মগুরুদের।
কিন্তু এসবে আশু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। ২০০৬ সালে আইনসভা নেসেটের নির্বাচনে ১২০টি আসনের মধ্যে নেতানিয়াহুর লিকুদ মাত্র ১২টি আসন পায়। বলতে গেলে তখন থেকেই উগ্র ডানপন্থার সঙ্গে ধর্মীয় রক্ষণশীল ও ধর্মীয় উগ্রবাদীদের নির্বাচনী সমর্থন লিকুদের দিকে নিয়ে আসার দিকে গুরুত্ব দেন নেতানিয়াহু। এই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের নির্বাচনী মৌসুমের পুরোটাই উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ইঙ্গিতপূর্ণ মুসলিম বিদ্বেষী বাক-বিস্তারে মনোনিবেশ করেন নেতানিয়াহু, যা উগ্র কট্টরপন্থী ইহুদিদের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়। আর ধর্মনির্ভর দলগুলোও নেতানিয়াহুর মাধ্যমে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ দেখতে পায়। নির্বাচনী মৌসুমে অবস্থার এত অবনতি ঘটে যে লেবার পার্টির মতো মধ্যপন্থী দলও উপরিউক্ত বিকৃতিতে অংশ নেয়। মর্মান্তিক ব্যাপার হচ্ছে, প্রগতিশীলতার দাবিদার লেবার পার্টিও দলনেতা এহুদ বারাকের ব্যক্তিস্বার্থের কাছে পরাজিত হয়ে সরকার গঠনে কড়া ডানপন্থী নেতানিয়াহুকে সমর্থন দেয়। এর বিনিমিয়ে বারাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদ পেয়ে যান। 
ইসরায়েলি ইহুদি মৌলবাদীদের দিনকে দিনকে শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে রাজনীতির মাঠের নানা হিসাব-নিকাশ ছাড়াও উদারপন্থী ধর্মগুরুদের একটি অংশের মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হওয়ার ভীতিজনিত নীরবতার ভূমিকা আছে। উদারপন্থী ধর্মপন্থীদের আরেকটি অংশের ধারণা, মৌলবাদীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিভেদ তৈরি হওয়াটা ধর্মীয় লাইনের জন্য অধিক ক্ষতিকর। তারা অবশ্যই ভুল। মৌলবাদ কোনো উদারতাই সহ্য করে না, ধর্মীয় উদারপন্থীদের তো একেবারেই নয়।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে গবেষক।