অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সংগঠিত দাঙ্গাকাণ্ডকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দেশকে কড়া ডান পন্থায় পরিচালনা করার একটা ভালো সুযোগ পেয়ে গেছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। সম্প্রতি দেওয়া এক ভাষণে দাঙ্গার কারণ নিয়ে কথা বলেছেন ক্যামেরন। তাঁর মতে, বর্ণবাদ, সরকারি ব্যয় সংকোচনের মধ্যে এবারের দাঙ্গার কারণ খুঁজে লাভ নেই। ঠিক কথা যে এবারের দাঙ্গার সঙ্গে বর্ণবাদকে যুক্ত করে দেখার অবকাশ কম। কিন্তু ২০১০-১১ বছরের জন্য গত বছরের মে মাসে ঘোষিত ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন পাউন্ড সরকারি ব্যয় সংকোচনের সঙ্গে দাঙ্গার কোনো সম্পর্ক না থাকার ব্যাপারে ক্যামেরনের দেওয়া প্রমাণটি বেশ আশ্চর্য রকমের। তিনি জানান, এ ব্যাপারে জন-অসন্তোষ থাকলে দাঙ্গাকারীরা হাইস্ট্রিটের দোকানপাট ভাঙচুর না করে পার্লামেন্ট ভবনের দিকে যাত্রা করত।
এটা কোনো কথা? দাঙ্গাকারীরা পার্লামেন্টের দিকে না যাওয়ায় ধরে নিতে হবে, সরকারের ব্যয় সংকোচনের ব্যাপারে জনমনে কোনো ক্ষোভ নেই! অথচ নানা বিশেষজ্ঞ মহল থেকেই সরকারি ব্যয় কমানো হলে কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক মন্দার প্রকোপে ভুগতে থাকা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরও খারাপ হয়ে যাবে বলে মত দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দারিদ্র্য সে যত কঠোরই হোক না কেন, তার সঙ্গেও দাঙ্গার কোনো সম্পর্ক দেখতে অরাজি ক্যামেরন।
তাহলে দাঙ্গা কেন হলো? ক্যামেরনের মতে, ঘটনাটি ‘আচরণগত’ সমস্যার সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলতে চাইছেন, ‘ঠিক ও ভুলের ব্যাপারে উদাসীন, দুমড়ানো-মুচড়ানো নৈতিকতা আর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ লোকজনের’ মধ্যে দাঙ্গার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এ ছাড়া মনে রাখতে হবে, ব্রিটেনের দরিদ্রতম কিছু লোকজনের মধ্যেই শুধু ‘নৈতিক অবক্ষয় ও অসদাচরণের সমস্যা’ বিরাজ করছে না, বরং সাম্প্রতিক কালে ব্যাংকগুলোর সৃষ্ট দুর্গতি, এমপিদের অর্থনৈতিক দুই নম্বরি, ফোন হ্যাকিং কেলেংকারি থেকে উঁচুতলাতেও সর্বনিম্ন স্তরের লোভ ও দায়িত্বহীনতার প্রমাণ দেখা যায়। কিন্তু ক্যামেরন ধরেই নিয়েছেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে গরিব লোকদের মধ্যেই প্রধানত নৈতিক অবক্ষয় ও অসদাচরণ দেখা দেয়। তবে ওপরতলাতেও কারও কারও মধ্যে এসব প্রবণতা দেখা যাওয়ায় ক্ষুব্ধ তিনি। নিচুতলায় সৃষ্ট পরিস্থিতির ব্যাপারে উঁচুতলার আদৌ কোনো দায়দায়িত্ব আছে কি না, তা জানাননি ক্যামেরন।
সমাজদেহে ক্ষোভের সঞ্চার, বিক্ষোভের প্রকাশ কিংবা হঠা ৎ বিস্ফোরণগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান অসাম্য-বৈষম্যের সংযোগ খুঁজে দেখতে রাজি নন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। এবারের দাঙ্গার সঙ্গে ব্রিটেনের পরিবারব্যবস্থার একটি ঘোরতর সম্পর্কও খুঁজে পেয়েছেন ক্যামেরন। নিম্ন আয়ের লোকদের মধ্যে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে অনীহা, সন্তান না নেওয়া আর সিঙ্গেল মাদারদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া তথা পরিবারব্যবস্থায় ভাঙনের সঙ্গে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কোনো যোগাযোগ দেখতে পান না ক্যামেরন। তিনি জানান, এবারের দাঙ্গায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনেকের ঘরেই বাবা নেই এবং তারা ‘সিঙ্গেল মাদার’ পরিবারে বড় হওয়া। ক্যামেরন মনে করেন, চোখের সামনে কোনো ‘পুরুষ রোল মডেল’ না দেখে, একজন ‘ফাদার ফিগারের’ অভাবে থেকে বড় হওয়া তরুণদের অনেকে এবার দাঙ্গায় নেমেছে! একজন যথার্থ ইংলিশ রক্ষণশীল পুরুষবাদীর মতো কথা বটে। ডেভিড ক্যামেরন বছর পাঁচেক আগে বর্তমানে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হওয়ার পর থেকে ‘ব্রোকেন সোসাইটি’র ধারণা উত্থাপন করে যাচ্ছেন। তিনি এটা ‘মেরামত’ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এবারের দাঙ্গার পর থেকে ক্যামেরন সত্যিই মরিয়া। এবার তাঁর নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের উদারভাবাপন্নতার যে গর্ব ব্রিটেন করে থাকে, প্রয়োজনবোধে তা বহুলাংশে বিসর্জন দিয়ে দেওয়া হবে।
প্রথমত, দাঙ্গার ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে বেকারদের জন্য চালু থাকা রাষ্ট্রের দেওয়া নানা সুবিধার ওপরে চরম কুঠারাঘাতে বদ্ধপরিকর ক্যামেরন। দরিদ্রবান্ধব এই সুবিধা-ব্যবস্থার মধ্যে সব সময় বাম পন্থার একটা গন্ধ খুঁজে পান তিনি এবং মনে করেন, এই ব্যবস্থার বড় সুফল ভোগ করছে জালিয়াত ও কর্মোদ্যোগহীন লোকেরা! দ্বিতীয়ত, মানবাধিকারের ব্যাখ্যা-বয়ানগুলোর ব্যাপারেও রাখঢাকহীন আপত্তি জানিয়ে দিয়েছেন ক্যামেরন। তাঁর দাবিমতে, ব্রিটেনে এখন মানবাধিকার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে গোঁজামিল ও গরমিলের পর্ব চলছে, যা কিনা ব্যক্তির দায়িত্বশীলতার প্রসঙ্গটিকে গুরুত্বহীন করে তুলছে। শুনতে আকর্ষণীয় হলেও এমন পর্যবেক্ষণ অতি বিপজ্জনক। উল্লেখ্য, ক্যামেরন জানিয়েছেন, কাউন্সিল অব ইউরোপের বর্তমান চেয়ারম্যানশিপের সুযোগটি ব্যবহার করে ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটসে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের চেষ্টা চালাবে ব্রিটেন। দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের মতো কঠোর দমনপদ্ধতির প্রতি আকর্ষণ দেখিয়ে আরও এক দফা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছেন ক্যামেরন। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একজন ‘স্ট্রিট ক্রাইম বিশেষজ্ঞ’কে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। ব্রিটিশরা গর্ব করে, তাদের পুলিশ অস্ত্র বহন করা ছাড়াই অপরাধ দমনে সক্ষম। কিন্তু ক্যামেরনের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, সেই দিন শেষ। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন তাদের দৃষ্টিতে যেসব ঘটনাকে বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতা মনে করে, সেগুলো দমনে শক্তি প্রয়োগ করে। বৈষম্যনির্ভর বিদ্যমান ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে ক্যামেরনের হাত ধরে উদারনৈতিকতার অন্যতম দাবিদার ব্রিটেন সে পথে হাঁটতে শুরু করে দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক।
এটা কোনো কথা? দাঙ্গাকারীরা পার্লামেন্টের দিকে না যাওয়ায় ধরে নিতে হবে, সরকারের ব্যয় সংকোচনের ব্যাপারে জনমনে কোনো ক্ষোভ নেই! অথচ নানা বিশেষজ্ঞ মহল থেকেই সরকারি ব্যয় কমানো হলে কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক মন্দার প্রকোপে ভুগতে থাকা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরও খারাপ হয়ে যাবে বলে মত দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দারিদ্র্য সে যত কঠোরই হোক না কেন, তার সঙ্গেও দাঙ্গার কোনো সম্পর্ক দেখতে অরাজি ক্যামেরন।
তাহলে দাঙ্গা কেন হলো? ক্যামেরনের মতে, ঘটনাটি ‘আচরণগত’ সমস্যার সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলতে চাইছেন, ‘ঠিক ও ভুলের ব্যাপারে উদাসীন, দুমড়ানো-মুচড়ানো নৈতিকতা আর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ লোকজনের’ মধ্যে দাঙ্গার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এ ছাড়া মনে রাখতে হবে, ব্রিটেনের দরিদ্রতম কিছু লোকজনের মধ্যেই শুধু ‘নৈতিক অবক্ষয় ও অসদাচরণের সমস্যা’ বিরাজ করছে না, বরং সাম্প্রতিক কালে ব্যাংকগুলোর সৃষ্ট দুর্গতি, এমপিদের অর্থনৈতিক দুই নম্বরি, ফোন হ্যাকিং কেলেংকারি থেকে উঁচুতলাতেও সর্বনিম্ন স্তরের লোভ ও দায়িত্বহীনতার প্রমাণ দেখা যায়। কিন্তু ক্যামেরন ধরেই নিয়েছেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে গরিব লোকদের মধ্যেই প্রধানত নৈতিক অবক্ষয় ও অসদাচরণ দেখা দেয়। তবে ওপরতলাতেও কারও কারও মধ্যে এসব প্রবণতা দেখা যাওয়ায় ক্ষুব্ধ তিনি। নিচুতলায় সৃষ্ট পরিস্থিতির ব্যাপারে উঁচুতলার আদৌ কোনো দায়দায়িত্ব আছে কি না, তা জানাননি ক্যামেরন।
সমাজদেহে ক্ষোভের সঞ্চার, বিক্ষোভের প্রকাশ কিংবা হঠা ৎ বিস্ফোরণগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান অসাম্য-বৈষম্যের সংযোগ খুঁজে দেখতে রাজি নন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। এবারের দাঙ্গার সঙ্গে ব্রিটেনের পরিবারব্যবস্থার একটি ঘোরতর সম্পর্কও খুঁজে পেয়েছেন ক্যামেরন। নিম্ন আয়ের লোকদের মধ্যে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে অনীহা, সন্তান না নেওয়া আর সিঙ্গেল মাদারদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া তথা পরিবারব্যবস্থায় ভাঙনের সঙ্গে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কোনো যোগাযোগ দেখতে পান না ক্যামেরন। তিনি জানান, এবারের দাঙ্গায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনেকের ঘরেই বাবা নেই এবং তারা ‘সিঙ্গেল মাদার’ পরিবারে বড় হওয়া। ক্যামেরন মনে করেন, চোখের সামনে কোনো ‘পুরুষ রোল মডেল’ না দেখে, একজন ‘ফাদার ফিগারের’ অভাবে থেকে বড় হওয়া তরুণদের অনেকে এবার দাঙ্গায় নেমেছে! একজন যথার্থ ইংলিশ রক্ষণশীল পুরুষবাদীর মতো কথা বটে। ডেভিড ক্যামেরন বছর পাঁচেক আগে বর্তমানে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হওয়ার পর থেকে ‘ব্রোকেন সোসাইটি’র ধারণা উত্থাপন করে যাচ্ছেন। তিনি এটা ‘মেরামত’ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এবারের দাঙ্গার পর থেকে ক্যামেরন সত্যিই মরিয়া। এবার তাঁর নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের উদারভাবাপন্নতার যে গর্ব ব্রিটেন করে থাকে, প্রয়োজনবোধে তা বহুলাংশে বিসর্জন দিয়ে দেওয়া হবে।
প্রথমত, দাঙ্গার ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে বেকারদের জন্য চালু থাকা রাষ্ট্রের দেওয়া নানা সুবিধার ওপরে চরম কুঠারাঘাতে বদ্ধপরিকর ক্যামেরন। দরিদ্রবান্ধব এই সুবিধা-ব্যবস্থার মধ্যে সব সময় বাম পন্থার একটা গন্ধ খুঁজে পান তিনি এবং মনে করেন, এই ব্যবস্থার বড় সুফল ভোগ করছে জালিয়াত ও কর্মোদ্যোগহীন লোকেরা! দ্বিতীয়ত, মানবাধিকারের ব্যাখ্যা-বয়ানগুলোর ব্যাপারেও রাখঢাকহীন আপত্তি জানিয়ে দিয়েছেন ক্যামেরন। তাঁর দাবিমতে, ব্রিটেনে এখন মানবাধিকার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে গোঁজামিল ও গরমিলের পর্ব চলছে, যা কিনা ব্যক্তির দায়িত্বশীলতার প্রসঙ্গটিকে গুরুত্বহীন করে তুলছে। শুনতে আকর্ষণীয় হলেও এমন পর্যবেক্ষণ অতি বিপজ্জনক। উল্লেখ্য, ক্যামেরন জানিয়েছেন, কাউন্সিল অব ইউরোপের বর্তমান চেয়ারম্যানশিপের সুযোগটি ব্যবহার করে ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটসে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের চেষ্টা চালাবে ব্রিটেন। দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের মতো কঠোর দমনপদ্ধতির প্রতি আকর্ষণ দেখিয়ে আরও এক দফা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছেন ক্যামেরন। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একজন ‘স্ট্রিট ক্রাইম বিশেষজ্ঞ’কে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। ব্রিটিশরা গর্ব করে, তাদের পুলিশ অস্ত্র বহন করা ছাড়াই অপরাধ দমনে সক্ষম। কিন্তু ক্যামেরনের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, সেই দিন শেষ। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন তাদের দৃষ্টিতে যেসব ঘটনাকে বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতা মনে করে, সেগুলো দমনে শক্তি প্রয়োগ করে। বৈষম্যনির্ভর বিদ্যমান ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে ক্যামেরনের হাত ধরে উদারনৈতিকতার অন্যতম দাবিদার ব্রিটেন সে পথে হাঁটতে শুরু করে দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন