রবিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১২

রিপাবলিকানদের প্রার্থী বাছাইয়ের আবডালে



শান্তনু মজুমদার | তারিখ: ০৭-০২-২০১২
বিপজ্জনক আশ্বাস, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের সুড়সুড়ি, কায়েমি স্বার্থবাদীদের মনপছন্দ কথাবার্তা, প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতা, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার—এসব মিলিয়ে বেশ জম্পেশ হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী দল রিপাবলিকান পার্টির হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে লড়াইয়ের প্রার্থীটি বেছে নেওয়ার অঙ্গরাজ্যভিত্তিক প্রাইমারি নির্বাচন-পর্বটি। সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাইমারিতে জেতা প্রার্থীই হবেন আগামী নভেম্বরে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী। সবকিছু এখনকার মতো থাকলে এই প্রার্থী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়বেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী বারাক ওবামার সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার খোয়াব অনেকেই দেখতে পারেন। 
প্রতিবার দেখা যায়, প্রধান দুই দলের বাইরে কিছু খুচরা প্রার্থীও নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যান; তাঁরা কেউ লোক হাসান, কেউ সামান্য সময়ের জন্য কিছু আলোড়ন তুলে হারিয়ে যান। দলের ভেতরেও একই অবস্থা হয়; এবারও তা-ই হয়েছে। শেষাবধি ‘কতজন এল-গেল’—একটা অবস্থাই তৈরি হয়েছে। দৌড়ে সত্যিকার অর্থে টিকে আছেন দুজন—তাঁরা হলেন ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর মিট রমনি ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসের সাবেক স্পিকার নিট গিংরিচ। রমনি ধনকুবের যুগের হাওয়া বুঝতে পারা মধ্যপন্থী রিপাবলিকান, যিনি রক্ষণশীলতার ধারক-বাহক হলেও দলের সমর্থকদের বাইরে সাধারণ মধ্যপন্থী ভোটারদের মন জয়ের আশায় প্রতিক্রিয়াশীলতার পক্ষে চিৎকার করা থেকে বিরত থাকেন। অন্যদিকে, গিংরিচ হচ্ছেন ‘ডানপন্থী’ রাজনীতির বলতে গেলে ক্ল্যাসিকাল উদাহরণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম-বর্ণের পুরুষ ভোটাররাই তাঁর মূল ভরসা। তবে মনে রাখা দরকার, এই তফাতগুলো অবশ্যই রমনি ও গিংরিচের মধ্যে অর্থপূর্ণ কোনো ভেদ তৈরি করে না। 
এই দুই প্রার্থীর মধ্যে বরং মিল আছে বেশ কিছু। 
রমনি ও গিংরিচ—দুজনই দলীয় প্রাইমারিগুলো জেতার জন্য নানা ধরনের বিপজ্জনক আশ্বাস দিয়ে চলছেন। জানুয়ারির শেষ দিনটিতে অনুষ্ঠিত ফ্লোরিডা প্রাইমারি নির্বাচনে জেতার জন্য মরিয়া গিংরিচ চাঁদের মাটিতে মার্কিনদের জন্য স্থায়ী একটি কলোনি তৈরির প্রতিশ্রুতি দেন। চাঁদ গিংরিচের পারিবারিক সম্পত্তি কি না, চাঁদের মালিকানা নিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বাকি বিশ্বের কোনো বক্তব্য থাকতে পারে কি না—এসব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারায় কেউ কোনো প্রশ্ন তুলেছে বলে জানা যাচ্ছে না। গড় মার্কিনদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতিতে এহেন সুড়সুড়ি দেওয়াকে খারাপ চোখেও দেখা হচ্ছে না। ব্যাপারটা এমন যেন, চাঁদ নামের উপগ্রহটি পৃথিবীর নয়, যুক্তরাষ্ট্রের! গিংরিচের চাঁদসংক্রান্ত ভাবনাকে রমনি উদ্ভট মনে করলেও গোটা বিশ্বকে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনা করা গিংরিচের এহেন মার্কিন-মস্তানির সে অর্থে কোনো সমালোচনা করেননি। ধরে নেওয়া যায়, গড় মার্কিনদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতিতে ঘা লাগার ভয়ে। বিপজ্জনক আশ্বাসের দিক থেকে রমনিও পিছিয়ে থাকছেন না। মধ্যবিত্তের সমর্থন লুটে নেওয়ায় বেপরোয়া এই অতিধনী প্রার্থী জানিয়েছেন, তিনি দরিদ্রদের নিয়ে উদ্বিগ্ন নন বরং তিনি মধ্যবিত্তকে সাহায্য করতে চান। এই মধ্যবিত্তরাই সমাজের ৯০-৯৫ ভাগ বলে দাবি করেন রমনি। কয়েক বছরব্যাপী মন্দাজনিত দুরবস্থা বিবেচনায় নিলে রমনির এই হিসাব মেনে নেওয়া মুশকিল। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, সরাসরি দরিদ্রবিরোধী অবস্থান নিলেও রমনির কোনো অসুবিধা হয়নি। ফ্লোরিডা প্রাইমারি বেশ ভালোভাবেই জিতেছেন তিনি। 
কায়েমি স্বার্থবাদীদের মনের মানুষ হয়ে ওঠার বাসনাতাড়িত রমনি ও গিংরিচ এবার লক্ষ্যণীয়ভাবে বেছে নিয়েছেন ফিলিস্তিন প্রসঙ্গটি। বলা হচ্ছে, সমস্যার জন্য ফিলিস্তিনিরাই দায়ী; ইসরায়েলিরা ‘দুই রাষ্ট্র’ভিত্তিক সমাধানে খুশিমনে রাজি থাকলেও ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য হচ্ছে ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। অনৈতিহাসিক এই বিষোদগার শুনতে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বা উগ্র জাতীয়তাবাদী ইসরেইল বেইতেনু পার্টি কিংবা কট্টর ইহুদি ধর্মবাদী শাস পার্টির কথাবার্তা মনে হয়। কিন্তু কথাটা মিট রমনির, যিনি কিনা রিপাবলিকান টিকিট পাওয়ামাত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তথা বিশ্বের অধীশ্বর হয়ে ওঠার পথে অর্ধেকটা পথ হেঁটে ফেলবেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে অত্যন্ত প্রভাবশালী জায়নবাদীদের একচেটিয়া হাততালি রমনির পক্ষে যাচ্ছে না। কেননা, গিংরিচ তো কম যাচ্ছেন না। গিংরিচ জানিয়েছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারলে তেলআবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস দ্রুততম সময়ের মধ্যে জেরুজালেমে নিয়ে যাবেন। তিনি মনে করেন, ওবামা আমলে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে না, বরং দেশটির সঙ্গে ঝগড়া বাধাচ্ছে এবং দেশটিকে পারমাণবিক বোমা-আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। গিংরিচ ইসরায়েল কর্তৃক গাজা অবরুদ্ধ করে রাখারও পক্ষে। এ ধরনের উক্তিতে দুই লাভ—এতে করে জায়নবাদী লবি তুষ্ট থাকছে আর ওবামার পিতৃধর্মের ব্যাপারটা একটুখানি মনে করিয়ে দিয়ে হালকা সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করে নেওয়া হচ্ছে, যা মূলধারার রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের আশ্বস্ত করে এবং মানসিক আরাম দেয়। গিংরিচের কথা এখানেই শেষ নয়। তিনি মনে করেন, ‘ফিলিস্তিনি’ জনগণ ব্যাপারটাই ‘বানানো’, তাদের বলতে হবে ‘আরব’; আর ‘দুই রাষ্ট্র’ সমাধান যদি বাস্তবায়ন করতেই হয়, তাহলে ‘ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে তারা শান্তি ও সমঝোতা চায়’। 
ইতিহাস, বস্তুনিষ্ঠতা, চোখের সামনে ঘটমান বর্তমান—কোনো কিছুই রমনি ও গিংরিচের বিবেচনায় নেই। গাজা থেকে ছোড়া বলতে গেলে অনেকটা প্রতীকী প্রতিবাদমূলক বেশির ভাগ সময় ক্ষতিহীন রকেটগুলো বড় হয়ে যায় রিপাবলিকান প্রার্থীদের কাছে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনির জীবনহানি, লাখ লাখ ফিলিস্তিনির উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া, বিশ্বজুড়ে মিলিয়ন মিলিয়ন শান্তিকামী মানুষের প্রত্যাশা—কিছুতেই কিছু এসে যায় না রমনি ও গিংরিচের। 
মার্কিন রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার সাংঘাতিক। প্রার্থীরা বলতে গেলে বাতিকগ্রস্তের মতো এই ইস্যুতে নিজেকে অন্যদের তুলনায় উত্তম প্রমাণে আকুল থাকেন। প্রেসিডেন্ট পদের লড়াইয়ে থাকার সময় নিজেকে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান একজন ক্যাথলিক প্রমাণের জন্য ওবামাকে কত চেষ্টাই না করতে হয়েছিল। আর ওবামার খ্রিষ্টানিতে গলদ খুঁজে বের করার জন্য গলদঘর্ম হতে হয়েছিল রিপাবলিকানদের। রাজনীতিতে ধর্ম নিয়ে মূল খেলাটা সারা দুনিয়ায় ডানপন্থীরাই খেলে। মধ্যপন্থী, উদারনীতিক, বামপন্থীরা কোথাও এর পাল্টা জবাব দিতে চায়, অনেক জায়গায় চাপ সামলাতে না পেরে খেলায় ঢুকে পড়ে। সে যা-ই হোক, মূল লড়াই যখন শুরু হবে, অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটদের প্রার্থী হিসেবে ওবামা মাঠে নামার পর ধর্মযুক্ত রাজনীতি আরও কুৎসিত করে তুলবেন রিপাবলিকানরা—এটা নিশ্চিত বলা যায়। এখন নিজেদের মধ্যে চলছে। গিংরিচের অভিযোগের মধ্যে আছে ম্যাসাচুসেটসের গভর্নর থাকার সময় রমনি কর্তৃক ক্যাথলিক হাসপাতালগুলোর ‘ইচ্ছার বিরুদ্ধে’ জন্মবিরতিকরণের পিল সরবরাহ চালু করা এবং সরকারি তহবিল থেকে নার্সিং হোমে বয়স্ক ইহুদিদের জন্য ‘ধর্মসম্মত’ কোশার খাবার সরবরাহের জন্য ছয় লাখ ডলার না দেওয়া। ধর্মীয় স্বাধীনতার বিরোধিতার ক্ষেত্রে রমনিকে ওবামার মতোই মনে করছেন গিংরিচ। এ ছাড়া রমনি যে একজন মর্মন (Mormon), এ কথাও নানা কায়দায় গিংরিচ শিবির থেকে প্রচার করে ফায়দা ওঠানোর চেষ্টা হচ্ছে। উল্লেখ্য, মর্মনরা যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া ক্ষুদ্র একটি খ্রিষ্টানধারা। তারা পুরুষের বহুবিবাহে বিশ্বাসী। বর্তমানে অবশ্য এই বিশ্বাসটির চর্চা সেভাবে হয় না; রমনি নিজেও এটা চর্চা করেন না, কিন্তু তার পরও রেহাই নেই। একই ধর্ম হলে কী হয়েছে? মর্মনরা নিজ ধর্মের ভেতরে সংখ্যালঘু, এমনকি মর্মনরা আদৌ খ্রিষ্টান কি না তা নিয়ে অনেক সময় তর্ক বাধিয়ে দেয় সংখ্যাগুরু ক্যাথলিক ধর্মবাদী বা প্রভাবশালী কট্টরপন্থী ইভানজেলিস্টরা। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারকারীরা সংখ্যালঘুদের শেষ করে দিতে চায়। সংখ্যালঘু ধর্ম না পাওয়া গেলে কিংবা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সাইজ করে ফেলা শেষ হয়ে গেলে, নিজ ধর্মের ভেতর সংখ্যালঘু ধারাকে বেছে নেয় এরা। রমনির ক্ষেত্রে এটা ঘটছে। রমনি নিজেও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করছেন। ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে জায়নবাদী ব্যাখ্যা-বয়ানের পক্ষ নিয়ে গোঁড়া ক্যাথলিক, গোঁড়া ইহুদি আর জায়নবাদীদের মন রক্ষায় রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করছেন তিনি। 
এ ছাড়া চলছে ডলারের খেলা। এ ক্ষেত্রে রমনি অনেক এগিয়ে। ধারেকাছে থাকছেন না গিংরিচ। তাঁর সম্বল উগ্র, আক্রমণাত্মক, কড়া রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল কথাবার্তা। সর্বশেষ ফ্লোরিডা প্রাইমারিতে জিতে অবস্থান অনেকটাই মজবুত করে নিয়েছেন রমনি। তবে গিংরিচ লড়ে যাচ্ছেন বেশ ভালোভাবে। নিজের পক্ষে সাফাইটা চমৎকার গাইছেন গিংরিচ। ১৯৯৬ সালে বব ডোল আর ২০০৮ সালে জন ম্যাককেইনের মতো মডারেট লোককে প্রার্থী বানিয়ে কী লাভ হয়েছে? প্রশ্ন গিংরিচের। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট—রমনি মডারেট। মডারেটে আর কাজ হবে না রিপাবলিকানদের। সাঁড়াশি লোক চাই হোয়াইট হাউস থেকে ডেমোক্র্যাট হটাতে। তবে রিপাবলিকানরা নতুন একজন জর্জ বুশকে বেছে না-ও নিতে পারে শেষ পর্যন্ত। ওবামা বিজয়ী হওয়ার পর থেকে হতাশা চলছে রিপাবলিকান শিবিরে। দেশটা ‘ইউরোপ হয়ে উঠছে’ মনে করে হাহাকারে আছেন অনেক কট্টর রিপাবলিকান। লোকজনের মধ্যে ধর্মভাব কমতে থাকা, উদারপন্থার দিকে একটু বেশি ঝোঁক দেখা যাওয়া—এ ধরনের কিছু ভয় তাদের মধ্যে কাজ করছে। এসব ভয় ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে গিংরিচের মতো প্রার্থী রিপাবলিকানদের মনের মতোন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, শুধু দলের লোক দিয়ে প্রেসিডেন্ট হওয়া যায় না। সেদিক থেকে ভাবলে রমনির মতো নিয়ন্ত্রিত মাত্রার রক্ষণশীলের গ্রহণযোগ্যতা সাধারণ ভোটারদের মধ্যে বেশি হয়। এহেন ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়ে এখন পর্যন্ত রমনি এগিয়ে। শেষ পর্যন্ত কে হবেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, তা জানার জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হলেও রমনির সম্ভাবনাই বেশি মনে হচ্ছে।
শান্তনু মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন